ধর্ষণ, ঠেকাতে হবে এখনি

ধর্ষণ, ঠেকাতে হবে এখনি

দেশে আশংকাজনক হারে বাড়ছে ধর্ষণের মতো অপরাধ। শুধুমাত্র চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ৩২ ভাগেরও বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, বিকৃত রুচি এবং মানবিকতাবোধের অভাব, নারীদের হেয় করে দেখা এবং বিচারহীনতার পরিবেশই ধর্ষণের পেছনের মূল কারণ।

অন্যদিকে যৌনশিক্ষার প্রচলন, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের নারীদের সম্মান করতে শেখানো এবং বিচারহীনতার পরিবেশ দূর করার মাধ্যমেই এ অবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

গত বুধবার ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে তুহিন নামে এক ফেরিওয়ালার বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ জানায়, ওই ছাত্রী পুরাতন খাতা বিক্রি করতে গেলে কৌশলে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায়ও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

একইদিন চুয়াডাঙ্গায় এক গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টায় বন্ধুকে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে স্বামীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মাদকাসক্ত স্বামীসহ ২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

তার পরের দিন বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় ৮ বছরের এক মাদরাসা ছাত্রের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বজনদের অভিযোগ, আইসক্রিম খাওয়ানোর কথা বলে শিশু সোহাগকে ডেকে নেয় একই এলাকার রিকশাচালক ইমন। পরে বলাৎকারে বাধা দেয়ায় তার মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। আটকের পর পুলিশের কাছে অভিযোগ স্বীকার করে ইমন।

কেবল প্রাপ্তবয়স্কই নয়, ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে শিশুদের বিরুদ্ধেও। গত রোববার (৭ মার্চ) চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় এক বাকপ্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ৫ম শ্রেণীর দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে। পরে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আদালতেও তোলে পুলিশ।

‘ধর্ষণ’র অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এগুলো সাম্প্রতিক কয়েকটিমাত্র। অপরাধগুলোর ধরণ যেমন আলাদা তেমনি এগুলোর কৌশলও অভিনব।

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৮৩ জন। এছাড়া নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ২৪২ জন। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিলো যথাক্রমে ৭৫৭ ও ২৩২।

‘অধিকার’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই ১১৫টি ঘর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ২৬ জন। অথচ ২০১৭ সালের প্রথম দুই মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো ৮৭ জন। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয় আরও ৩৪ জন।

অর্থাৎ গত দুই বছরে ধর্ষণের হার বেড়েছে।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সামাজিকভাবে হেয় হবার ভয়ে ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারগুলো এমন ঘটনা অহরহ গোপন করেন। তাই এটা পরিস্কার যে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

কিন্তু কেন এতো ধর্ষণ? এ ধরণের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার কারণই বা কী?

পুরুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন সময় নিউজকে বলেন, ধর্ষণের বহুবিধ কারণ রয়েছে। তবে যারাই ধর্ষণ করে তারা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। দেশে যদি ২০ টা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তবে তার প্রত্যেকটিরই আলাদা কারণ থাকলেও মূলত প্রতিবাদে অক্ষমরাই বেশি ধর্ষণের শিকার হন। মাদক, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং মানবিকতাবোধের অভাবই এর মূল কারণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক উম্মে ওয়ারা সময় নিউজকে বলেন, সমাজে ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা ঠিক, তবে এমন ঘটনা সমাজে নতুন কিছু নয়। বর্তমানে ধর্ষণের ঘটনা বেশি নজরে আসায় আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি বলে মনে হয়। আমাদের দেশে যেসব ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয় সেগুলো মূলত গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়। বর্তমানে দেশের গণমাধ্যমগুলো ধর্ষণের ঘটনাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। পাঠকপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করেই হয়তো তারা এমনটা করছে। আর এর ফলে মনে হচ্ছে ধর্ষণ অনেক বেশি ঘটছে।

এই প্রবণতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমাজে যখন কোনো অপরাধ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে তখন ওই অপরাধের প্রতি অপরাধপ্রবণ মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে চাঞ্চল্যকর বেশকিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে বনানীর ঘটনা। এরপর থেকে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। যদিও গণমাধ্যম বিষয়টি বেশি ফোকাস করছে। এছাড়া ধর্ষণের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যৌন শিক্ষার অভাব, বিদ্যালয়ে নীতিশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা, ধর্মীয়ভাবে নারীদের সম্ভ্রমকে গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখা।

এই অপরাধ বিজ্ঞানী আরও বলেন, ধর্ষণের পর ধর্ষিতা নারীর পরিবার সাধারণত বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। নিজেদের সম্মানহানির ভয়ে অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা অপারগতা দেখা যায়। এ কারণে অপরাধীরা আরও বেশি সুযোগ পায়। অন্যদিকে ইন্টারনেটের প্রসারতায় পর্নোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক অনেক বাড়ছে। পর্নোগ্রাফিতে সাধারণত নারীকে পণ্যের মতো উপস্থাপন করা হয়। যখন কোনো পুরুষ এটা দেখেন তখন তার মধ্যেও নারীকে ইচ্ছেমতো ব্যবহারের ভাবনা তৈরি হয়। এটা ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব সময় নিউজকে বলেন, নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, সব শ্রেণির মধ্যেই বাড়ছে এ অপরাধ প্রবণতা। এর পেছনে মূল কারণ, নারীর দেহকে পুরুষের পণ্য হিসেবে দেখার প্রবণতা। ধর্ষণের পর ধর্ষিতা নারীর প্রতিবাদ করার ‘অক্ষমতা’, অপারগতা ও বিচারে ক্ষমতাবানদের প্রভাব খাটানোর প্রবণতা। এছাড়া আমাদের সমাজের নাটক ও সিনেমাগুলোতে নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তাদের দেহের ওপর পুরুষদের এমন একটা অধিকার রয়েছে যে চাইলেই তারা নারীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন।

ধর্ষণের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের পোশাকের বিষয়টি উঠে এলেও প্রত্যেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন নারীর পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী হতে পারে না। যদি সেরকমটাই হতো তবে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটত না।

বিশেষজ্ঞদের কথায় ধর্ষণের পেছনের মূল কারণ হিসেবে বারবার উঠে এসেছে বিচারহীনতার প্রসঙ্গ। ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিষয়ে আদালত এবং বাদী পক্ষের বরাতে করা এক প্রতিবেদনে দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যম জানায়, দেশে গেল ১৫ বছরের ধর্ষণ মামলার চিত্র আমলে নিয়ে দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ০৬ শতাংশ মামলায় অপরাধীর শাস্তি হয়েছে।

তবে সম্প্রতি সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছে, গেল চার বছরে দেশে ১৭ হাজার ৩৯৮টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৩ হাজার ৫২৮টি শিশু ধর্ষণ ও ১৩ হাজার ৮৬১টি নারী ধর্ষণের মামলা। এসব মামলার মধ্যে ৩ হাজার ৪৩০টি মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে যাতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ৬৭৩ জন। শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৭ জনের ফাঁসির আদেশ, ৮০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫৭৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে।

ধর্ষণ বৃদ্ধি সমাজে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক শাহ এহসান বলেন, এর ফলে নারীরা হীনমন্যতায় ভুগবেন। আত্মবিশ্বাসের অভাব ছাড়াও বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে ভুগবেন নিরাপত্তাহীনতায়। এছাড়া নষ্ট হবে সামাজিক শৃঙ্খলা।

এতে সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সবার মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হবে যে, পুরুষ মানেই ধর্ষক এবং নারী মানেই ধর্ষিত। বিশ্বের যেকোনো সমাজের জন্যই এমন ধারণা ক্ষতিকর, যোগ করেন শাহ এহসান।

সমাজে ধর্ষণে প্রবণতা কমানোর উপায় কী? বিশেষজ্ঞরা সবার আগে বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার কথা।

সমাজে ধর্ষণের প্রবণতা কীভাবে কমতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে উম্মে ওয়ারা বলেন, বিদ্যালয়গুলোতে যৌনশিক্ষার প্রচলন চালু করতে হবে। যৌনতা সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই ধারণা দিতে হবে, সন্তানদের নারীদের প্রতি সম্মান দেখানো শেখাতে হবে। বিচারহীনতার প্রবণতা দূর করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

আর এহসান হাবীব বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। পুলিশের মামলা নেয়ার অপারগতা দূর করা ছাড়াও আদালতে নারীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রেও কিছুটা শালীনতা বজায় রাখা দরকার বলে মনে করেন ড. এহসান হাবীব।

তবে ড. কামাল হোসেনের মতে, যারা ধর্ষণ করেন তাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে কারও মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা পরিলক্ষিত হলে তাকে মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে পরীক্ষা করে চিকিৎসা দিতে হবে। অপরাধ বন্ধে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ এখন অনেক জরুরি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment