brandbazaar globaire air conditioner

আনিস মাষ্টার এর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

আনিস মাষ্টার এর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

বিশেষ প্রতিনিধি:

নিজেকে পুড়িয়ে, নানা ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে একজন মানুষ স্থান করে নেয় ইতিহাসের সোনালী পাতায়। তেমনি একটি নাম আনিছ উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে আনিছ মাষ্টার। ১৯৪৬ সালে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলাধীন নয়নশ্রী ইউনিয়নের ইছামতি নদীর কুলঘেষা খানেপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন আনিছ উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে আনিছ মাষ্টার। ব্যবসায়ী পিতা রাজিউদ্দিন আহম্মেদ ও মাতা ছবিয়া বেগমের আট সন্তানের মধ্যে তিনি সপ্তম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাতা ও তের বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে নানা বাড়ি ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার ঈশাননগর গ্রামে বিখ্যাত ডেপুটি বাড়িতে স্থান পান।
তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কান্দা খানেপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৬৬ সালে মানিকগঞ্জ ভিক্টোরিয়া স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাজে ১৯৭৪ সালে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
সে সময়ে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চ পদস্থ পদে বেশ কয়েকটি সরকারী চাকুরীর সুযোগ পেয়েও তিনি তা গ্রহন করেননি। তার জন্মভুমিকে আরও বড় কিছু উপহার দিতে, নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। সে সময়ে খানেপুর গ্রামে নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্তের পরিবারের বসবাস ছিল। সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর শিশুদের পড়ালেখা করার জন্য কোন সুযোগ ছিলো না। খৃষ্ঠান মিশনারী পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম-হিন্দুদের ভর্তিও সুযোগ ছিলো সীমিত। মেয়েদের লেখাপড়ার অবস্থা ছিলো আরোও শোচনীয়। মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে পড়াকালীন সময়ে নিজগ্রামে বিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন ছিলো তখন থেকেই।
সেই লক্ষ্যে ১৯৬৭ সালে নিজ খানেপুর গ্রামের জনসাধারনের সহায়তায় খানেপুর-আলালপুর নামে জুনিয়র হাইস্কুল গড়ে তোলেন। এরপর অল্প দিনের মধ্যেই বিদ্যালয়ের নামকরণ নিয়ে খানেপুর বনাম আলালপুরের মধ্যে শুরু হয় বাক-বিতন্ডা। খানেপুরের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বিদ্যালয়ের নামকরণ করতে চায় ’নবু বেপারী’ জুনিয়র হাইস্কুল। কিন্তু স্থানীয় মোল্লা সম্প্রদায়ের যুক্তি ছিল বিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে আলালপুর শব্দটি যুক্ত না করলে তারা কোন আর্থিক সহযোগিতা করবেন না। এমনি তর্ক বিতর্কের মাথায় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭৬ সালের পর দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করার পর অবশেষে ’কান্দা খানেপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে প্রতিষ্ঠা করে আনিছ উদ্দিন মাষ্টার নিজে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহন করেন। এসময়ে আনিছ মাষ্টার তার সহধর্মিনী বেগম কামরুন্নাহার, ভাইয়ের স্ত্রী শামসুন্নাহার হেনা, ভাতিজা বধু আসমা নাজিমুদ্দিন প্রমুখকে নিয়ে সহকারী শিক্ষিকার দায়িত্ব দেন।
এ উদ্যোগ যেমন থামেনি, তেমনি থেমে থাকেনি ষড়ষন্ত্র। বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় যাদের জমি ছিল,তারা প্রথমে বিদ্যালয়ের নামে জমিদানের ওয়াদা করলেও পরে সে ওয়াদা তারা রক্ষা করেনি। তৎকালীন চেয়ারম্যান যিনি বিদ্যালয় গর্ভনিং বডির সভাপতি ছিলেন তিনি কার্যকরী ভুমিকা না রেখে ভিতরে ভিতরে বিরোধিতা করে কালবৈশাখী তান্ডব তৈরী করেন।
১৯৮৪ সাল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। যেহেতু তৎকালীন চেয়ারম্যান বিদ্যালয়ের পক্ষে কোন ভুমিকা না রাখার দায়ে প্রধান শিক্ষক আনিছ মাষ্টারের চাচাত ভাই সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ কাজল ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। ভোটযুদ্ধে সামান্য কয়েক ভোটে পরাজিত হোন আনিছ মাষ্টারের ভাই সিরাজ কাজল। বিজয়ী চেয়ারম্যান তার দলবল নিয়ে প্রতিশোধ স্বরুপ বিদ্যালয়ের চেয়ার-টেবিল, বে সহ আসবাবপত্র বিদ্যালয়ের বাহিরে ফেলে দেয় এবং কোন শিক্ষার্থী যেন এই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা না করেন হুমকি প্রদান করেন।
এরপর ১৯৮৬ সাল কেটে যায় দুটি বছর হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান নির্বাচিত চেয়ারম্যান। সৃষ্টি হয় উপ-নির্বাচনের পরিবেশ। উপ-নির্বাচনে আনিছ মাষ্টারের ভাই সিরাজ কাজল বিপুল ভোটে বিজয়ী হন এবং সৃষ্টি হয় স্কুল পুন:প্রতিষ্ঠার।
আনিছ মাষ্টারের পরিবারের সক্রিয় সহযোগিতায় এবং সাবেক মন্ত্রী আতাউদ্দিন খান সাহেরের অর্থায়নে নব উদ্যমে আনিছ মাষ্টার শুরু করেন উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। নতুন নামকরণ দেওয়া হয় “খানেপুর উচ্চ বিদ্যালয়” নামে। অবশেষে সরকারী স্বীকৃতি পায় ১৯৯৪ সালে।
এদিকে যড়ষন্ত্রকারী সুযোগ খুঁজতে থাকে ।সময়ও তাদের নাগালে আসে। তখন ১৯৯৬ সাল। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও একুশে ফেব্রুয়ারি একই দিনে। সেদিন সকালে বিদ্যালয়ের মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষ হতে না হতেই বিরোধিরা মরনকামড় দেন। ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে মুছল্লিরা আহত হন। অপরদিকে, আনিছ মাষ্টারসহ তার ভাই সিরাজ কাজলের উপড় হামলা চালানো হয়। আনিছ মাষ্টারের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে আনিছ মাষ্টার ও তার ভাই সিরাজ কাজল গুরুত্বর আহত হন। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সিরাজ কাজল সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন তার ভাই আনিছ মাষ্টার ও তার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে বিরোধীরা। শুধু আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা স্কুল ও বাড়ি ঘরের মালামাল লুট করে নিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় একাধিক মামলা হয়।
এরপর ১৯৯৮ সালে আনিছ মাষ্টারের ভাই সিরাজ কাজল অর্থ ও অবৈধ পেশিশক্তির কাছে পরাজিত হন। তারপরেও থেমে থাকেনি আনিছ মাষ্টার। তিনি ২০০১ সালে বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত করান। এতে আবারোও অসন্তোষ হন বিরোধীরা। তারা তৎকালীন বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী আ. মান্নান সাহেবের স্মরণাপন্ন হন। আ. মান্নানের নির্দেশে তৎকালীন ইউএনও আবু সাঈদ ফকিরের হস্তক্ষেপে এডহক কমিটি করা হয়। পরে এডহক কমিটি বিদ্যালয়ের বিরোধীদের সাথে সমন্ময় করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যাদের বিন্দুমাত্র অবদান নাই তাদেরকে প্রধান করে একটি পকেট কমিটি বানানো হয়। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা মরহুম আনিছ উদ্দিন মাষ্টারের বিরুদ্ধে বিষদগার করে বিবৃতি প্রদানসহ দূর্নীতি দমন ব্যুরোতেও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের ও তা তদন্তের অনুরোধ করা হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির এমপিও ভুক্ত বাতিলের লিখিত অনুরোধ জানান।
অবশেষে প্রধান শিক্ষক আনিছ উদ্দিন সকল বাধা বিপত্তির,মামলা,ষড়ষন্ত্র সততার সহিত মোকাবেলা করে তা প্রতিরোধ করে সফল হন। আনিছ উদ্দিন মাষ্টার শুধু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি এলাকার উন্নয়নেও বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। খানেপুর গ্রামে কোন বাজার ও পোষ্ট অফিস ছিলো না। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজ,চিঠি আদান-প্রদান,নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য প্রায় দশ কিলোমিটার দুরে বান্দুরা বাজার অথবা দাউদপুর বাজারের যেতে হত সকলকে। এখন প্রতিদিন বৃহৎ কলেবরে হাট-বাজার বসছে। এক সময়ে কোন ডাকঘর না থাকাতে যথাসময়ে কোন চিঠি, টেলিগ্রাম,মানি অর্ডার সঠিক সময়ে পাওয়া যেত না। কোন চিঠি,টেলিগ্রাম,মানি অর্ডারের প্রয়োজন হলে ফসলের মাঠ পেরিয়ে সাত মাইল পায়ে হেটে দেউতলা যেত হতো। এখন খানেপুরবাসী ঘর থেকে বের হলেই হাট-বাজার, পোষ্ট অফিস, মার্কেট, স্কুল ও পাকা রাস্তা-ঘাট সবই আছে। শুধু নাই আমাদের মাঝে আনিছ উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে আনিছ মাষ্টার।
আনিছ উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে আনিছ মাষ্টার আমাদের মাঝে রেখে গেছেন তার স্ত্রী বেগম কামরুন্নাহার, কান্দা খানেপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। তার জোষ্ঠ কন্যা আফরোজা আক্তার (বিএ), শিক্ষিকা খানেপুর উচ্চ বিদ্যালয়। দ্বিতীয় সন্তান কন্যা চ ল আক্তার (এমএ)। তৃতীয় সন্তান কন্যা নুসরাত জাহান ইতি (এমএ)। চতুর্থ সন্তান কন্যা বিথি আক্তার (এমএ), স্বামী সহকারী কমিশনার (ট্যাক্স)। প ম ও শেষ সন্তান পুত্র আসাদুজ্জামান (এমবিএ), ব্রান্ড বাজারের স্বত্তাধিকারী ও দৈনিক আগামীর সময়ের প্রকাশক ও সম্পাদক।

Related posts

Leave a Reply