রিজার্ভ চুরির টাকা ফিরে পেতে আশাবাদী গভর্নর

সিস্টেম হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিরে পেতে আশাবাদী হয়ে ওঠেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি মনে করছেন, রিজার্ভ উদ্ধারে যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, তাতে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পেতে বেশিদিন লাগবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার মামলা দায়ের করা হয়েছে উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিলিপাইনের কোথায় কোথায় রক্ষিত রয়েছে, সেই তথ্য আমাদের কাছে তথ্য আছে। ফিলিপাইনের ভেতরেই একাধিক জায়গায় এ অর্থ আছে। রিজার্ভ চুরিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত এবং যাদের কাছে আমাদের রিজার্ভের টাকা রয়েছে তাদের সবাইকে দায়ি করে মামলা করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়াতেই আমরা রিজার্ভের চুরি যাওয়া টাকা ফিরে পাবো বলে আশা করছি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে শনিবার (২ ফেব্রুয়ারি) এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে রিজার্ভ চুরির নিয়ে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

ফজলে কবির জানান, গত বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে দায়ের করা মামলায় ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) এবং ওই ব্যাংকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ডজনখানেক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

তিন বছর আগে রিজার্ভ চুরির আলোচিত ওই ঘটনায় জড়িত এবং সুবিধাভোগীদেরই আসামি করা হয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর বলেন, ৬৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন (৬ কোটি ৬৫ লাখ) ডলার আদায়ে এ মামলা হয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক আমাদের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করেছে মামলার প্রথম থেকে শুরু করে প্রতিটা ডলার উদ্ধার পর্যন্ত তারা আমাদের সঙ্গেই থাকবে।

মামলার রায় হতে এবং টাকা ফিরে পেতে কতোদিন লাগতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলেন, নির্দিষ্ট করে তা এখনই বলতে পারছি না। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হতে পারে। নিউ ইয়র্কের যে কোর্টে এ মামলা করা হয়েছে, সেখানে সাধারণত দ্রুতই মামলা নিষ্পত্তি হয়। ফিলিপাইনে হলে অনেক বিলম্ব হতো। ওখানে অনেক দীর্ঘসূত্রতা আছে। নিউ ইয়র্কে অনেক সুবিধা। আমরা আশা করছি, খুব বেশি সময় লাগবে না।

ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক করপোরেশন (আরসিবিসি( কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের এ মামলাকে ভিত্তিহীন বলে বিবৃতি দিয়েছে, এ প্রসঙ্গে গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গভর্নর বলেন, রিজার্ভ চুরির সব অর্থ আরসিবিসির ওখানে গিয়েছিল, এর প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। আরসিবিসিতে চারটা ভুয়া অ্যাকাউন্টে মোট গিয়েছিল ৮১ মিলিয়ন ডলার এবং ওই অ্যাকাউন্টগুলো বৈধ না। এই অবৈধ কাজের জন্য আরসিবিসিকে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোচ্চ সাজাও দিয়েছে। তাদেরকে জরিমানা করা হয় এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) পেসো, অর্থাৎ ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আরসিবিসি যে অবৈধ কাজ করেছে তা প্রমানিত রাষ্ট্রীয়ভাবেই। এটা লন্ডার্ড মানি ছিল। এই কারণে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। কাজেই আরসিবিসি যতোই বিবৃতি দিক না কেনো, তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড আগেই প্রমাণিত।

২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সুইফট সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া ম্যাসেজ পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করা হয়। ওই অর্থ ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার চারটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে। সেখান থেকে ওই অর্থ ফিলিপাইনের মুদ্রা পেসোতে রূপান্তরের পর দুটি ক্যাসিনোতে পাঠানো হয়। রিজার্ভ চুরির এই ঘটনায় দোষী প্রমাণ হওয়ায় গত ১০ জানুয়ারি আরসিবিসির সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া দেগুইতোকে সাজা দেন ফিলিপাইনের আদালত। এছাড়াও তাকে সর্বমোট ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানা করা হয়েছে।

চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার ফিরে আসে গত দুই বছরে, আর ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ফিরে এসেছে মাত্র ১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। ফিলিপাইনের একটি বড় ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে ওই টাকা উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হলেও বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার উদ্ধারে তেমন কোনও অগ্রগতি নেই। জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে, তারও কোনও হদিস মেলেনি।

ওই অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করা হবে। এজন্য দেশটিতে দুটি ল’ ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের ফি নিয়ে একটি চুক্তিও করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, চুরি যাওয়া ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার উদ্ধার করে দিতে পারলে ল’ ফার্ম দুটিকে সেই অর্থের ১০ ভাগ দেওয়া হবে।

এদিকে রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনতে ফিলিপাইন সরকারের সংশ্লিষ্টরা শুরুতে সব ধরণের সহযোগিতা দিয়ে আসলেও হঠাৎ রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক করপোরেশন (আরসিবিসি) বলেছে, এর দায় বাংলাদেশের। এরপরই বলতে গেলে বন্ধ হয়ে যায় উদ্ধার প্রক্রিয়া। সম্প্রতি এ অর্থ ফিরে পেতে ফের তৎপর হয়েছে বাংলাদেশ। এ উদ্দেশে গত ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি প্রতিনিধি দল বর্তমান ফিলিপাইনে অবস্থান করছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে গত ২ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে মামলা হয়েছে। তবে প্রায় ৬ কোটি ডলার উদ্ধার হবে কিনা, হলেও সেটি কবে তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment