গুজরাট দাঙ্গার জেল-খাটারা যেভাবে ছাড়া পাচ্ছেন

ভারতে সতেরো বছর আগেকার গুজরাট দাঙ্গায় সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল যেখানে, সেই নারোদা পাটিয়া মামলায় ভারতে একের পর এক অভিযুক্ত জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন। ওই মামলাতে জেল খাটছিলেন, এমন চারজনকে এ সপ্তাহেই সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিয়েছে।

মাসকয়েক আগেই ওই একই মামলাতে অব্যাহতি পেয়েছেন বিজেপি নেত্রী ও সাবেক মন্ত্রী মায়া কোদনানি, যার নেতৃত্বে নারোদা পাটিয়াতে হত্যালীলা চালানো হয় বলে অভিযোগ ছিল।

ভারতে অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, গুজরাটের দাঙ্গাপীড়িতরা যে আদৌ ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না তা এসব ঘটনা থেকেই প্রমাণিত।

আহমেদাবাদের নারোদা পাটিয়া মহল্লায় ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অন্তত ৯৭ জন মুসলিমকে যেভাবে মারা হয়েছিল, সেটা গুজরাট দাঙ্গার সবচেয়ে বীভৎস হত্যাকান্ডগুলোর একটি। সেদিন অনেককে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, এমন কী একজন গর্ভবতী নারীর পেট চিরে ভ্রূণ বের করে সেই সন্তান ও মা দু’জনকেই কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকেই জানিয়েছেন।

কিন্তু সেই মামলায় নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হয়ে জেল খাটছিলেন, এমন চারজনের দন্ডাদেশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছে এবং দু’দিন আগে তারা প্রত্যেকেই শীর্ষ আদালত থেকে জামিন পেয়ে গেছেন।

গুজরাটে দাঙ্গাপীড়িতদের হয়ে বহু বছর ধরে লড়ছেন আহমেদাবাদের অ্যাক্টিভিস্ট নির্ঝরিণী সিনহা। তিনি বলছিলেন, নারোদা পাটিয়া মামলায় নিম্ন আদালতে কিন্তু খুব ভালো বিচার হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্ট বা উচ্চতর আদালতে পৌঁছানোর পরই দেখা যাচ্ছে হয় সেগুলোতে হয় প্রসিকিউশন ঠিকমতো হচ্ছে না, কিংবা আগের সাক্ষ্য গ্রাহ্য হচ্ছে না এবং দণ্ডিতরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন।

“সব কিছু যে ঠিকঠাক হচ্ছে না, সেটা বোঝাই যাচ্ছে এবং ভিক্টিমদের সঙ্গে ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্স সিস্টেমের এটা যেন চরম একটা প্রহসন।”

নারোদা পাটিয়া হামলায় যিনি নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ, সে সময়কার বিজেপি সরকারের মন্ত্রী মায়া কোদনানিও প্রায় পাঁচ বছর জেল খাটার পর গত এপ্রিলে গুজরাট হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পেয়ে যান।

নারোদা পাটিয়ার বাসিন্দারা সে সময় বিজেপির গুজরাটি বিভাগকে বলেছিলেন ওই সিদ্ধান্তে তাদের বিচার পাওয়ার আশা চুরমার হয়ে গেছে।

ফতিমা বেন, নাঈমা শেখরা দাঙ্গার সময় স্বচক্ষে দেখেছিলেন কীভাবে কোদনানি ঘুরে যাওয়ার পরই মহল্লায় হাঙ্গামা চালানো হয় এবং তাদের মা-বোনদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।

‘গুজরাট ফাইলস’ বইয়ের লেখিকা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক রানা আয়ুবও মনে করছেন মায়া কোদনানির মুক্তির সময় থেকেই যেন এই বিচারের ধারাটা পুরো উল্টে গেছে।

তিনি বলছিলেন, ২০১২ সালে নিম্ন আদালতে কিন্তু বিচারক জ্যোৎস্না ইয়াগনিক তাকেই ওই গণহত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী বলে চিহ্নিত করেছিলেন – আর সেটা করা হয়েছিল চল্লিশজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে।

“কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সাক্ষীরা হয় বিগড়ে যাচ্ছেন, কিংবা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম ঠিকমতো তদন্তই করছে না – যার পরিণতিতে এরা জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন।”

আরএসএস-সমর্থক আইনজীবী রাঘব অবস্থী অবশ্য দাবি করছেন, ট্রায়াল কোর্টের রায় উল্টে যাওয়াটা একটা রুটিন ঘটনা, প্রতিদিন অসংখ্যবার ঘটে থাকে।

বিচারবিভাগের প্রতিটা পদক্ষেপে রাজনীতি দেখা উচিত নয় বলেও তার অভিমত। নির্ঝরিণী সিনহা আবার বলছিলেন, নারোদা পাটিয়া মামলায় যেভাবে একটা সময় মায়া কোদনানিরে মতো প্রভাবশালী রাজনীতিবিদেরও জেল হয়েছিল তাতে ভিক্টিমদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল ঠিকই – কিন্তু এখন একের পর এক মুক্তি আর জামিনে তারা বিচারবিভাগের ওপরই আস্থা হারিয়ে ফেলছেন, যা কোনও গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়!

অ্যাক্টিভিস্টরা তাই বলছেন, উচ্চ আদালতে যেভাবে একের পর এক রায় আসছে তাতে মনে হচ্ছে নারোদা পাটিয়াতে ওই শখানেক মুসলিম নারী-পুরুষকে যেন কেউই কখনও মারেনি! সূত্র: বিবিসি বাংলা।

https://www.youtube.com/watch?v=vT0glgr46-M

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment