রূপগঞ্জে হাত পাখার কদর বেড়েছে

রূপগঞ্জে হাত পাখার কদর বেড়েছে

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ

এমন একটা সময় ছিল, গ্রাম বাংলায় ঘরে ঘরে স্বামীর সামনে খাবার পরিবেশন করা হত। তিনি খাচ্ছেন। আর পাশে বসে আছেন স্ত্রী। তার হাতে একটি নক্সি পাখা। এক হাতে স্বামীকে বাতাস করে চলেছেন তিনি! এভাবে বাতাস করার মধ্য দিয়ে মূলত নিজের গভীর ভালবাসাটুকুই প্রকাশ করতেন নারীরা। পতিদেবতাটি মুখে হয়তো কিছু বলতেন না, ভালবাসা অনুভব করতেন ঠিকই। অতি আপনজন বন্ধু বা ভালবাসার মানুষকেও উপহার হিসেবেও দেয়া হতো নক্সি পাখা। সুই সুতোর নক্সার মাধ্যমে এ পাখাগুলোকে বিশেষ আকর্ষণীয় করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যেত। এখন এগুলো সবই স্মৃতি।
হাতপাখা আজ শুধু ঘাম আর গরম থেকে আত্মরক্ষার উপকরণই নয়, চিরায়ত গ্রামবাংলার কুটির শিল্পের অন্যতম অংশও বটে। গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করে রূপগঞ্জের গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। গরমে শরীরে শীতল হাওয়ার পরশ বুলিয়ে দেয় তালপাতার পাখার বাতাস। রূপগঞ্জের সদর ইউনিয়নের ইছাপুরা, ভোলান, পলহান, কুমারটেক, পশর্^ী, বাগবের,গুতিয়াব এলাকার তালপাতার পাখা এখানকার নারীদের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে পাখা তৈরির কাজকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

গরম বাড়ছে। বেড়েই চলেছে।  বৈদ্যুতিক পাখা আছে প্রায় সব ঘরে। এমনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বিপুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যয়। তাই খোঁজ করতে হয় না হাতপাখাটির। হ্যাঁ, একরকম হারিয়েই গেছে। তাই বলে হাতপাখার যে ঐতিহ্য, সে তো হারাবার নয় কোনদিন। কিছুকাল আগেও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের খুব উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ ছিল হাতপাখা। তখন দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুত ছিল না। বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহারও খুব কম চোখে পড়ত। মানুষ গরম থেকে বাঁচতে মূলত হাতে তুলে নিত হাতপাখা। তোমার হাত পাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে…। সত্যি প্রাণ জুড়াত হাতপাখার বাতাসে।
একটা সময় বিভিন্ন রকমের নক্সি পাখা তৈরি হতো গ্রামবাংলায়। তালপাতার পাখার কথা তো সবারই জানা। বাঁশ বা বেত দিয়েও পাখা তৈরি করা হতো। অনেকটা পাটি বোনার মতো করে পাখার মূল অংশ বুনে নেয়া হতো। বাঁশ ফালি করে কেটে ধারালো দায়ের সাহায্যে পাতলা লম্বা বেতি বের করা হতো। বেতির বুননের মাধ্যমে পাখার বিভিন্ন নক্সা করা হতো। বেতিতে উজ্জ্বল রং মেখে নিয়ে তা দিয়েও পাখা বুনা হতো। ফলে পাখাগুলো আলাদা দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হতো।

তবে নক্সি পাখা বলতে প্রধানত সূচিকর্ম করা পাখার কথা বোঝায়। নক্সি কাঁথার কথা আমরা জানি। নক্সি পাখার বেলায়ও নানা নক্সা করা হতো। নারীরা পাখার মাঝখানটায় যতেœর সঙ্গে সূচিকর্ম করতেন। সুই সুতোর বুননে বিভিন্ন লোক মোটিফ তুলে ধরতেন। লতা পাতা ফুল পাখি মাছ গাছ ইত্যাদির উপস্থাপনা দেখা যেত হাতপাখায়। ফলে হাত ঘুরালে শীতল বাতাস যেমন পাওয়া হতো, তেমনি মুগ্ধ করত এর কারুকৃতি। গ্রামীণ নারীদের পতি-প্রেম পতি-ভক্তির বিচিত্র প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। দেখা গেছে। তবে একটি দৃশ্য সবার স্মৃতিতে নিশ্চিতভাবেই রয়ে গেছে।
শীতের সময়টায় নিজ এলাকা ছাড়াও আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তালগাছের পাতাসহ ঢিঙ্গা সংগ্রহ করে সে সব পুকুরের পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। ফালগুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু করেন তারা। ভোলানের সাপিয়া বেগম তালপাতার ঢিঙ্গা, পাতা দিয়ে পাখা তৈরি করছিলেন। সাপিয়ার মতে, পাখা তৈরির কাজ তাদের বাপ -দাদার পেশা নয়। স্বামীর সংসারে এসে পাখা তৈরির কাজ শিখেছেন। এখনো করছেন।এখন এটাই পেশা । তিনি জানান, চার রকমের পাখা তৈরি করেন। এসব পাখার মধ্যে রয়েছে ডাটা পাখা, ঘুরকি পাখা, হরতন পাখা ও পকেট পাখাই বেশি তৈরি করেন। প্রতিটি পাখা ৮ টাকা থেকে শুরু করে ২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে খুচরা বিক্রি করলে আরো বেশি দাম পাওয়া যেতো।
এখানে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করেন তারা বিভিন্ন আইটেম অনুযায়ী কাজ করেন। শ্রমিকদের মজুরী কাজের ধরন ভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাাকে। ১০০ পাখা রঙ করলে ৬০ টাকা, ঘুরকি তৈরি করলে ৫০ টাকা, পাখা বাঁধলে ৪০ টাকা। তাদের মতে, এখানকার প্রতিটি পরিবার ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পাখা তৈরি করেন। চৈত্র মাস থেকেই শুরু হয় পাখা বিক্রির কাজ। আশি^ন মাস পর্যন্ত তা বিক্রি হয়। ষোল বছর আগে আমি বিয়ে করে শশুরবাড়ি আসি। এরপর থেকেই হাতপাখা তৈরির কাজ করছি। আমার স্বামী রিপন মিয়াও আমার সঙ্গে দিন-রাত কাজ করেন। ছেলেটি লেখা পড়া করল না। মেয়ে সানজিদাকে লেখাপড়া করানোর ইচ্ছে আছে। ও স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের পাখা তৈরির কাজে সহগযোগিতা করে। এই পাখা বিক্রির আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলে।
এরপর যদি কখনো কিছু থাকে তা ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের জন্য রেখে দেই। বললেন, “পাখার গ্রাম” খ্যাত রূপগঞ্জের ইছাপুরা  এলাকার  সাপিয়া খাতুন। দক্ষিণবাঘ এলাকার পাখা তৈরির কারিগর রওশনারার পাখা তৈরির কাজ তাদের বাপ দাদার আদি পেশা। এ প্রসঙ্গে রওশনারা বলেন, এ পেশার ওপর নির্ভর করেই এখানকার অধিকাংশ পরিবার জীবিকা নির্বাহ করেন। ছনি এলাকার গৃহবধু সাহানারা বেগম বললেন অন্য কথা, তার মতে কারো পাখা তৈরিতে যা খরচ হয় তার দ্বিগুন টাকা বিক্রি হয়। অনেকের আবার শতকরা ৪০ ভাগ টাকা লাভ হয়। চৈত্র মাস থেকে পাখা বিক্রি শুরু হয়। বাইরের লোকজন এখানে ভাদ্র মাস পর্যন্ত পাখা কেনেন।
ন্থানীয় হাট বাজারগুলোতে ও পাড়া মহল্লায় আশি^ন মাস পর্যন্ত ফেরি করে পাখা বিক্রি করা হয়। আরেক গৃহবধু জাহানারা বেগম বললেন, বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসে পাখা তৈরির কাজটিকেই প্রধান কাজ হিসেবে নিয়েছি। ছেলেমেয়েরাও আমাদের পাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে। তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে মাত্র এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার পর আর লেখা পড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। পাখার কাজ না থাকলে জমির কাজ করে। আরিন্দা গ্রামের আমেনা বেগমের দুই ছেলে মেয়ে। মেয়ে বাধন কে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ইমন মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
আমেনার মতে , তার স্বামী ও তিনি মিলে সকাল থেকে আছর নামাজের ওয়াক্ত পর্যন্ত ৮০-৯০ টি পাখা তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি পাখা বিক্রি করে খরচ বাদে ৫-৭ টাকা আয় হয়। একই গ্রামের রাহেলা বেগমও জানান, সংসারে বাড়তি খরচ না থাকায় তারা কিছু জমি কেনার জন্য সঞ্জয় করেছেন। এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা ফাতেহা নুর বলেন, এখন আর আগের মতো নাই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বসতি নির্মানের জন্যে গাছ-গাছালি কেটে ফেলা হচ্ছে। পাখা তৈরির তাল গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। তবে একটা সময় ছিল উপজেলার ইছাপুরা, কুমার টেক, পলহান, ভোলান, বাঘবেড় , দক্ষিণবাঘসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকহারে তালপাতার পাখা তৈরি হতো।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন