সেফটিপিন: ১৭১ বছরের ফ্যাশনে

সেফটিপিন: ১৭১ বছরের ফ্যাশনে

আলপিন আর সেফটিপিন দুই ভাই। আলপিন শুধু হুল ফুটিয়েই গেল। আর সেফটিপিন? আপনি পুরুষ হয়ে থাকলে জিজ্ঞেস করি, সেফটিপিন দিয়ে আপনি কী করতেন? একবার ভাবুন তো বসে বসে। আর নারী হলে সে প্রশ্ন করারই দরকার নেই। কেন নেই? কারণ, সেফটিপিনের ব্যবহার পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি করেন এবং সেটা ফ্যাশনের প্রয়োজনেই।

সেফটি পিন
সেফটি পিন

সেফটিপিন খুব হেলাফেলার বিষয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু ফ্যাশনের ক্ষেত্রে সেফটিপিন কোনো হেলাফেলার জিনিস নয়। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, ব্লাউজের সঙ্গে শাড়ি আটকাতে, জামার সঙ্গে ওড়না আটকাতে খুব কার্যকরভাবেই ব্যবহার করা হয় সেফটিপিন। মনে পড়ছে? এটা কিন্তু এখনো নারীরা একই কাজে ব্যবহার করে চলেছেন সেই আদ্যিকাল থেকে। আদ্যিকাল বলছি তার কারণ, আমরা এখন যে সেফটিপিন দেখি, সেটা প্রথম পেটেন্ট নেওয়া হয় ১৮৪৯ সালে, আমেরিকায়। পেটেন্ট নেন সে সময়কার বিখ্যাত যন্ত্রকৌশলী ওয়াল্টার হন্ট। সে হিসেবে সেফটিপিনের বয়স ১৭১ বছর! আর মজার ব্যাপার হলো, সেফটিপিনের আদি নাম ‘ড্রেস পিন’। মানে এই পিন দিয়ে কাপড় আটকানো হতো।বিজ্ঞাপন

পিন দিয়ে কাপড় আটকানো অবশ্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। মধ্য ব্রোঞ্জযুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৫০-১৫৪০) মধ্য ইউরোপে এটির সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। এরপর বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে কাপড় আটকানোর পিন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা আধুনিক সেফটিপিন পেয়েছি, সেটাও কাপড় আটকানোর জন্যই।

মেটালের তৈরি প্রজাপতি। শাড়ি কিংবা ওড়না আটকাতে ব্যবহার করা হতো এ ধরেনর ব্রোচ। এগুলোর নিচে লাগানো থাকত সেফটি পিন
মেটালের তৈরি প্রজাপতি। শাড়ি কিংবা ওড়না আটকাতে ব্যবহার করা হতো এ ধরেনর ব্রোচ। এগুলোর নিচে লাগানো থাকত সেফটি পিন

এখন যে অল ইন ওয়ান ডায়াপার দেখা যায় মূলত শিশুদের ব্যবহারের জন্য, উনিশ শতকেও এ রকম ডায়াপার ব্যবহার করা হতো আমেরিকা আর ইউরোপে। সেগুলোর সাধারণ নাম ছিল ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাট বা এখনকার অল ইন ওয়ান ডায়াপারের পূর্বসূরি ডায়াপারগুলো আটকানো থাকত পিন দিয়ে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে, অর্থাৎ ১৮৪৯ সালের পর থেকে কাজটি করে আসছে সেফটিপিন। এ ছাড়া কাপড় আটকাতে তো তার ব্যবহার ছিলই। আমেরিকা বা ইউরোপে বিশেষত নারীদের পোশাকের যে ধরন ছিল আঠারো বা উনিশ শতকে, তাতে পিনের মতো একটা কিছুর প্রয়োজন হতোই। সে জায়গাটা পূরণ করে সেফটিপিন।

তবে সেফটিপিন ফ্যাশনজগতের আইকন হয়ে ওঠে বেশ পরে। বলা চলে উনিশ শ সত্তরের দশকে। এর পেছনে তখনকার পাংক রক শিল্পীদের অবদান অনেক বেশি। পাংক রক শিল্পীদের অনেকেই ফ্যাশনের জন্য সেফটিপিন ব্যবহার করতেন বিশেষভাবে। এ ছাড়া বিভিন্ন পোস্টারেও সেফটিপিন ব্যবহার করে গেছেন তাঁরা। পাংক রক এবং সেফটিপিনের কথা উঠলেই উঠে আসে বিশ শতকের সত্তরের দশকের বিখ্যাত ব্যান্ড ‘সেক্স পিস্তল’-এর কথা। সম্ভবত এই ব্যান্ড সেফটিপিনকে ফ্যাশনের জগতে প্রতিষ্ঠা করে গেছে।

‘গড সেভ দ্য কুইন’ গানের পোস্টার। রানির মুখ সেফটি পিন দিয়ে আটকানো
‘গড সেভ দ্য কুইন’ গানের পোস্টার। রানির মুখ সেফটি পিন দিয়ে আটকানো

ব্রিটিশ এই পাংক রক ব্যান্ডের গানের নাম ‘গড সেভ দ্য কুইন’। এখানে দেখা যায়, ভোকাল জনি রটেন অনেকগুলো সেফটিপিন দেওয়া একটি শার্ট গায়ে দিয়েছেন। এর আগে পাংক রক ব্যান্ডের কাউকে সেফটিপিন ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। এরপর থেকেই পাংক রক সংগীত জনরার শিল্পীদের মধ্যে সেফটিপিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় বলে মনে করেন অনেকে। অবশ্য তার আগে ওই সত্তরের দশকেই ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ভিভিয়ান ওয়েস্টউড তাঁর নকশা করা পোশাকে, বিশেষত টি-শার্টে, সেফটিপিনের ব্যবহার করেছেন। সেই সত্তরের দশকেই ফ্যাশন ডিজাইনার জান্ড্রা রোডস, জুডি ব্লেমের মতো ফ্যাশন ডিজাইনাররাও তাঁদের পোশাক ও গয়নায় সেফটিপিন ব্যবহার করেন।বিজ্ঞাপন

বিশ্ব ফ্যাশনজগতে এই ধারা চলতে থাকে উনিশ শ নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। স্টিফেন স্প্রাউস কিংবা জিন পল গালটিয়ারের মতো ফ্যাশন ডিজাইনার এবং এলিজাবেথ হার্লের মতো ভুবনবিখ্যাত অভিনেত্রীরা ফ্যাশনের জগতে সেফটিপিনকে অমরত্ব দিয়ে গেছেন। সে ধারা যে এখনো চলছে, সেটা না বললেও চলে। ২০১৬-১৭ সালের শরৎ বা শীতের পোশাকের কালেকশনে বালেনসিগা, ভায়নেট ও সোনিয়া রাইকিয়েলের মতো বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনাররা সেফটিপিনকে আবারও ফ্যাশনের ঝাঁ-চকচকে মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন।

জিয়ান্নি ভার্সেসের নকশা করা সেফটি পিন পোশাকে  অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লে, ১৯৯৪
জিয়ান্নি ভার্সেসের নকশা করা সেফটি পিন পোশাকে অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লে, ১৯৯৪ 

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেফটিপিন বিশ্ব ফ্যাশন মঞ্চের রঙিন দুনিয়ায় আসার আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার ব্যবহারিক কারণে। শুরুতেই বলেছি, শুধু ইউরোপ কিংবা আমেরিকাই নয় অথবা চকচকে চেহারার তন্বী মডেলরাই শুধু নন, আমাদের দেশের সাধারণ নারীরা প্রতিদিন ব্যবহার করে চলেছেন সেফটিপিন। বিভিন্ন রকম ধাতুতে বানানো প্রজাপতি, মৌমাছি কিংবা বিভিন্ন ফুলের পেছনে লাগানো সেফটিপিন একসময় শিশুদের ফ্যাশনেও ব্যবহার হয়েছে আমাদের দেশে। হ্যাঁ, সেগুলো ফ্যাশন দুনিয়ার চলতি ফ্যাশনের অক্ষম অনুকৃতি ছিল বটে। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের চলতি ফ্যাশনের জগতে তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

গলায় সেফটি পিনের নকশা পরেছেন জুডি ব্লেম, ১৯৭৭
গলায় সেফটি পিনের নকশা পরেছেন জুডি ব্লেম, ১৯৭৭

যাহোক, বলছিলাম যে সেফটিপিন ফ্যাশনজগতের এক অদ্ভুত সংযোজন। ভীষণ সরব তার উপস্থিতি ফ্যাশন দুনিয়া হয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে। পাংক রকের মতো একটি সংগীত জনরার ফ্যাশন আইকন হয়ে ওঠা এই খুবই ছোট্ট যন্ত্রটির প্রতি মানুষের একধরনের আধ্যাত্মিক যোগাযোগের কথাও শোনা যায় বিভিন্ন লেখায়। জানা যায়, হোমার তাঁর ‘ওডিসি’ মহাকাব্যে কাপড়ে ব্যবহার করা পিনের কথা লিখেছিলেন, যার রং ছিল সোনালি, সেই পিনের বর্তমান রূপ সেফটিপিন। উনিশ শ তিরিশের দশকেও সোনালি রঙের সেফটিপিন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, ইউরোপে। কাজেই ফ্যাশন থেকে আধ্যাত্মিক ভাবনা, সেই সঙ্গে ব্যবহার উপযোগিতা, সেফটিপিন ভবিষ্যতে আরও কত যে খেলা দেখাবে, তা বলা যায় না এখনই।

সোর্স: লাভ টু নো ডট কম, বিলবোর্ড, অ্যানাদার

আপনি আরও পড়তে পারেন