দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সহযোগিতা মেলেনি

দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সহযোগিতা মেলেনি

আগেই বুঝতে পারছিলাম আমার সন্তান ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সুপথে আনার চেষ্টা করেছি বারবার। হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের জানানো হলে তাঁরা আমাকে বলেন, আপনি পয়সাওয়ালা। ছেলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে। দেখবেন চলে আসবে। কিন্তু সে তো আর আসেনি। জঙ্গি খাতায় সত্যি সত্যি নাম উঠে গেছে তার। গতকাল রবিবার বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন গুলশানে নিহত জঙ্গি মীর সামিহ মোবাশ্বেরের বাবা মীর হায়াত কবির। হায়াত কবির একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মা খালেদা পারভীন সরকারি তিতুমীর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপিকা। সামিহর পরিবারের মতো একই কথা বলছে একই ঘটনায় নিহত রোহান ইবনে ইমতিয়াজের পরিবারও। রোহানের বাবা সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপমহাসচিব এস এম ইমতিয়াজ খান বাবুল। ঘটনার পর থেকে দুটি পরিবারের স্বপ্ন দুমড়েমুচড়ে গেছে। তারা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের অভিযানে গোলাগুলিতে প্রাণ হারায় ছয় জঙ্গি। তাদের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় উদ্ঘাটন করা হয়েছে। দুজনের বাসার ঠিকানার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি তিনজনের বাসার ঠিকানা পাওয়া না গেলে তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। এরা সবাই ঢাকার নামিদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল।

দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সহযোগিতা মেলেনি

আওয়ামী লীগ নেতা এস এম ইমতিয়াজ খান বাবুল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লালমাটিয়ার বি ব্লকের একটি বাসায় বসবাস করেন। আট বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন। এক ছেলে দুই মেয়ের জনক তিনি। ছেলে রোহান স্কলাসটিকা স্কুল থেকে এ লেভেল সম্পন্ন করে। পরে ভর্তি হয় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। আর দুই মেয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। গতকাল দুপুরে রোহানের বাসায় গিয়ে কলিংবেল চাপার পর ভেতর থেকে এক নারী নিজেকে রোহানের ফুফু পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। তবে তিনি তাঁর নাম প্রকাশ করেননি। রোহানের ফুফু বলেন, তাঁর ভাই বাবুল, ভাবি ও দুই ভাতিজি আজ (গতকাল) সকালে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন। তা ছাড়া ভাইয়া ও ভাবি অসুস্থ। রোহানের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে রোহানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আত্মীয়স্বজনের বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ওই সময় ভাইয়া ও ভাবি চিকিৎসার জন্য ভারতে অবস্থান করছিলেন। পরে তাঁরা দেশে এসে ৪ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরি নাম্বার ২৮৯।’ তিনি আরো বলেন, সন্তানকে ফেরত পেতে ভাইয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, পুলিশ কমিশনার ও র‌্যাবের মহাপরিচালকের কাছে বারবার ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু কেউ সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেননি। তাঁদের বলা হয়েছিল—‘আমার সন্তানটির চালচলন কেমন যেন হয়ে গেছে। আমরা সবাই মুসলমান। ইসলামের প্রতি আমাদের দুর্বলতা আছে। কিন্তু রোহানের দুর্বলতাটি ছিল অন্য রকমের। সে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা হচ্ছিল।’ এগুলোও পুলিশকে অবহিত করা হয়। তারা শুধু বলেছিল, ‘বিষয়টি দেখা হবে। রোহান যদি বাসায় ফিরে আসে তাহলে আমাদের জানাবেন। তাকে কাউন্সেলিং করা হবে।’ প্রশাসনের দুর্বলতার কারণেই আমার ভাতিজা আজ জঙ্গি হয়ে গেল। রাষ্ট্রের কি উচিত ছিল না নিখোঁজ যুবকটির সন্ধান দেওয়া। কিন্তু তারা তো কিছুই করেনি। আজ একটি ঘটনা ঘটে গেল, তারপর হইচই শুরু হলো। কোথায় ছিল আগে এত হইচই। নিরপরাধ লোকজনকে জিম্মি করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাল রোহান। আর্মির কমান্ডোদের গুলিতে কচি প্রাণটি ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ইন্টারনেটে আইএস রোহানের যে ছবিটি প্রকাশ করেছে তা সত্য। তবে পুলিশের দেওয়া ছবিটি বোঝা যাচ্ছে না। তার পরও বলব, আমাদের সন্তানটি খারাপ কাজ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। জীবনে কল্পনাও করিনি সন্তানটির কারণে পরিবারের মানসম্মান শেষ হয়ে যাবে। বাবা-মা-বোনদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। আমাদের পরিবারের ইজ্জত ও ঐতিহ্য আছে। কোনো কিছুর অভাব ছিল না আমাদের। রোহানকে নামকরা স্কুলে পড়ানো হয়েছে। সেই ছেলে আজ নেই—এই কথা বলেই তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

ওই বাসায় প্রায় ৩০ বছর ধরে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন নুরুন নবী ওরফে নুরু মিয়া। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোহান জঙ্গি হামলায় অংশ নিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। সে এত বড় জঙ্গি তা কখনো বুঝতে পারিনি। রোহান ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমাকে বলেছিল, দাদু আসছি। আমার জন্য দোয়া করবেন। কোথায় যাচ্ছ জিজ্ঞাসা করলে রোহান জানায় বাইরে যাচ্ছি। তারপর থেকে সে নিখোঁজ।’  নুরু মিয়ার স্ত্রী রেজিয়া খাতুন বলেন, ‘রোহানের চালচলন ছিল একটু অন্য রকম। সে এত বড় জঙ্গি সন্ত্রাসী তা বুঝতে পারিনি।’ তিনি আরো বলেন, রোহানের বাবা ভালো মানুষ। তাঁর দুটি মেয়েও খুব ভালো। রোহানকে নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ছিল। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে বাবুল সাহেব পাগল হয়ে গেছেন। সব শেষ হয়ে গেছে তাঁর।

মীর সামিহ মোবাশ্বেরের বাবা মীর হায়াত কবির। তাঁদের বাসা বনানী ডিওএইচএসের ৫ নম্বর রোডে। হায়াত কবিরের দুই সন্তান। বড় ছেলে কানডার টরন্টোতে পড়াশোনা করেন। আর সামিহ স্কলাসটিকা থেকে সম্প্রতি ও লেভেল সম্পন্ন করেছে। চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাসায় এই প্রতিবেদক গেলে সামিহর বাবা দেখা করতে রাজি হননি। পরে তিনি মোবাইলে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘দুটি সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। ছেলের চালচলন অন্যদিকে চলে যাচ্ছে তা আগেই টের পেয়েছিলাম। নিখোঁজ হওয়ার পর গুলশান থানায় জিডি করা হয়েছিল। পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সব অবহিত করা হয়েছিল। তাঁরা কিছু করেননি, কোনো কথাও রাখেননি। সামিহ যেন দেশের বাইরে যেতে না পারে সে জন্য বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনকে বলা হয়েছিল। পুলিশ ঠিকমতো তদন্ত করলে আজ এই পরিণতি হতো না। শুক্রবার রাতে গুলশানের ঘটনার সময়ও বুঝতে পারিনি আমার সন্তান ওখানে আছে। যদি জানতে পারতাম তাহলে আমি ওই হোটেল গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে হলেও ছেলেকে ওখান থেকে নিয়ে আসতাম। কিন্তু আর বাকি রইল কী? সব শেষ…।’

শোকে ভেঙে পড়া মীর হায়াত কিছুটা থেমে আবারও বলতে থাকেন। তিনি বলেন, সামিহ যা চাইত তাই পূরণ করা হতো। জঙ্গি সংগঠনগুলো ভদ্র পরিবারের সন্তানদের কৌশলে তাদের দলে ভেড়াচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আগামী বছর তাকে পড়ালেখার জন্য কানাডায় পাঠানোর কথা ছিল। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। এই কথা বলে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। অঝোরে কাঁদতে থাকেন। সামিহের মা খালেদা আক্তার সরকারি তিতুমির কলেজের অধ্যাপিকা।

– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2016/07/04/377587#sthash.ukDuqxCC.dpuf

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment