‘মেয়ে ফোন করে বলে, বাবা বাড়ি ফিরে আসো, টাকার দরকার নেই’

‘মেয়ে ফোন করে বলে, বাবা বাড়ি ফিরে আসো, টাকার দরকার নেই’

কুষ্টিয়ার খোকসা থানার জয়েন্তি হাজরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক। গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাজপথে এমপিওভুক্তির ( মান্থলি পে অর্ডার) দাবিতে অবস্থান করছেন। ৩১ ডিসেম্বর থেকে করছেন অনশন। না খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। হাতে স্যালাইনের সুঁই লাগানো। বাড়ি থেকে প্রায় প্রতিদিনই আব্দুর রাজ্জাককে ফোন করে তার মেয়ে। তিনি বলেন, ‘মেয়ে ফোন করে বলে, বাবা বাড়ি ফিরে আসো, টাকার দরকার নেই। আম্মু কান্নাকাটি করে। তুমি না খেয়ে কিভাবে থাকো? টাকার দরকার নাই তুমি চলে আসো।’ বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) বিকালে এ প্রতিবেদকের কাছে মেয়ের এই আকুতি শুনিয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে; আমি বলি, না। টাকা পাওয়ার দিনক্ষণ পেলে চলে আসবো। মরে গেলে যাবো। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না।’  দিন নেই,  রাত নেই— রাস্তায় পড়ে আছেন রাজ্জাকের মতো আরও কয়েকশ মানুষ গড়ার কারিগর। যাদের থাকার কথা বিদ্যালয়ে, শিক্ষার্থীদের সামনে, তারা এখন কনকনে শীতে রাস্তায় বসে চোখের জল ফেলছেন। শিক্ষকতা করে যে সামান্য ক’টা টাকা পান, তাতে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। বাধ্য হয়েই তারা নেমেছেন পথে, করছেন অনশন। তাদের দাবি একটাই— এমপিওভুক্তি আর তার নির্দিষ্ট দিনক্ষণের ঘোষণা। শুধু আশ্বাস নিয়ে তারা আর বাঁচতে চান না।
‘মেয়ে ফোন করে বলে, বাবা বাড়ি ফিরে আসো, টাকার দরকার নেই’শিক্ষকদের এখন একটাই আশা, প্রধানমন্ত্রী তাদের দেখবেন। তিনি আশ্বাস দিলে পাঁচ মিনিটও রাস্তায় থাকবেন না বলে জানান অনশনরত শিক্ষকরা। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়ন কলেজের শিক্ষক রাশেদুল হাসান গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় এসে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন। এরপর থেকে এখানেই আছেন এই আশা নিয়ে— এমপিওভুক্ত হওয়ার ঘোষণা আসবে। রাস্তায় শুয়ে আছেন তিনি। শরীর দুর্বল, এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতেও সমস্যা হচ্ছিল তার। তার মতো অনেকের অবস্থা প্রায় এরকমই। হতাশা আর অনিশ্চয়তায় শারীরিক-মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন অনেকে।  শীতের রাতে এভাবেই রাস্তায় পড়ে থাকেন শিক্ষকরা। এরই মধ্যেই অনেকে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের দুর্ভোগ চরমে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়া শিক্ষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১২ জনে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়েছে ৯ জনকে। তবে রাজপথ ছাড়েননি তারা, অনশন থেকে সরে আসেননি।
আন্দোলনরত নন-এমপি শিক্ষকরা জানান, এমপিওভুক্তির দাবিতে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে আসছেন তারা। এই পাঁচ বছরে তারা অনশন করেছেন, অবস্থান ধর্মঘট করেছেন, শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের এমপিওভুক্তির দাবি পূরণ হয়নি। গত দুই অর্থবছরের বাজেটেও তাদের এমপিওভুক্তি বা বাড়তি ভাতার জন্য কোনও বরাদ্দ রাখা হয়নি। তাই গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে তারা ফের নেমেছেন রাজপথে। এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালেও তা প্রত্যাখ্যান করে তারা ৩১ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন।  তবে আশার কথা এই যে, নন-এমপিও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের এই আন্দোলন অবশেষে হয়তো আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। জানা গেছে, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে নতুন এমপিওভুক্তি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরে সংশোধিত এমপিও নীতিমালার খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে খসড়াটি চূড়ান্ত হয়ে আসার পর শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন চাওয়া হবে। এরপর যাছাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এমপিওভুক্ত করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব সালমা জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন এমপিওভুক্তি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মাউশি থেকে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কাজ করবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে থোক বরাদ্দ পেলে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে তা যাচাই-বাছাই হবে। দেখা যাক কী হয়।’
আশার আলো দেখা গেলেও আন্দোলরত শিক্ষকরা বলছেন, যত কষ্টই হোক, এবারে সুনির্দিষ্ট কোনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ না পেলে তারা রাজপথ ছাড়বেন না।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment