‘স্থবির’ বিএনপিতে ‘হতাশা’

প্রায় দেড় মাস ধরে কারাগারে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। নেতাকর্মীদের ব্যস্ততা তার মুক্তির দাবি করে কর্মসূচি পালন নিয়ে। কিছু কর্মসূচি পালিত হয়েছে নির্বিঘ্নে, কিছু কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা।

কর্মসূচি কতদিন চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে তা নিয়েও সন্দিহান নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা। এর মধ্যে দলীয় প্রধানের সহসা মুক্তির আশাও ক্ষীণ হয়ে আসছে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া খালেদা জিয়া সেদিন থেকেই আছেন কারাগারে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার আপিল গ্রহণ করার তিন দিন পর বিএনপি নেত্রীর জামিন আবেদনের শুনানি হয়।
‘স্থবির’ বিএনপিতে ‘হতাশা’১২ মার্চ চার মাসের জামিন দেয় হাইকোর্ট বেঞ্চ। কিন্তু এই আদেশের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করে ১৬ মার্চ। আর এই আবেদনের ওপর শুনানি হয় ১৮ মার্চ। পরদিন আপিলের আবেদন গ্রহণ করে খালেদা জিয়ার জামিন ৮ মে অবধি স্থগিত করে আপিল বিভাগ।

যদিও কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে আইনজীবী সবার বক্তব্য ছিল দ্রুত সময়ে মুক্তি পাবেন খালেদা জিয়া। আর এখন তারাই বলছেন, সরকারের ছাড়া মুক্তি পাবেন না তিনি।আর এমন অবস্থা হবে তা নিজেরা ভাবেননি।

থেমে আছে পুনর্গঠন,নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ভাটা

এদিকে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতেও ভাটা। এ নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই বিএনপিতে। স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডও স্থবিরপ্রায়।

বিএনপির ভাবনায় এখন শুধুই দলের প্রধানের মুক্তির আন্দোলন। যদিও তিনি বাইরে থাকাবস্থায় বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে তোড়জাড় দেখা গেছে।

 

মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রধানের আটকে তাদের প্রচার প্রচারণাও থমকে গেছে।

অন্যদিকে রাজধানীতে শুরুর দিকে শান্তিপূর্ণভাবে খালেদার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি পালন করতে পারলেও পরের দিকে এসে পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়েছে বিএনপির।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে এ পর্যন্ত তিনবার তারিখ ঘোষণা করেও কর্মসূচি পালনের অনুমতি পায়নি দলটি। যে কারণে নতুন করে তেমন কোনো কর্মসূচিও দিতে পারছে না বিএনপি। বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা হচ্ছে, সার সেগুলো পালিত হচ্ছে দায়সারাভাবে।

তবে কেন্দ্র ঘোষিত বিভাগীয় শহরে নানা চাপের মধ্যেও একাধিক সমাবেশ করছে বিএনপি।

দক্ষিণাঞ্চলের একটি আসন থেকে নির্বাচনে আগ্রহী বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এভাবে আর কতদিন? পরিস্থিতি যা তাতে চেয়ারপারসন মুক্তিও পাবেন না, দলও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে না।নির্বাচন তো দূরের কথা।’

বিএনপির জেলা পর্যায়ের নেতারা বলছেন, চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলনে পুরো মনোযোগ দেয়ার কারণে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে পিছিয়ে পড়ায় আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। তাই মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়াও জরুরি বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতারা।

গত ৮ মার্চ বিএনপির সিনিয়র নেতারা বেগম জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গেলেও নির্বাচন নিয়ে কোনো কথাই বলেননি বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে তেমন কোনো দিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি নেতাদের।

সাক্ষাৎ করে আসা একজন নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এখনই নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সময় আসেনি। চেয়ারপারসন দ্রুত মুক্তি পেলে এ নিয়ে পুরোদমে ভাবা যাবে। আর আমরা তো সবসময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আর যদি তার কারাবরণ দীর্ঘ হয় তখন বেগম জিয়ার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’

খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পরপরই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করে তার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরদার করতে জেলা সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গত মাসে সিদ্ধান্ত নিলেও সেটা কার্যকর করতে পারেনি দলটি।

খালেদা জিয়া কারাগারে থাকার অজুহাতে ঢাকা মহানগর বিএনপির দুই ভাগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো ঘোষণা করা হয়নি। এ নিয়ে পদ প্রত্যাশীদের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। মহানগর বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

সারাদেশের জেলা কমিটিগুলো পুনর্গঠনের যে উদ্যোগ ইতিপূর্বে নেয়া হয়েছিল তাও বন্ধ হয়ে আছে। ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে বারবার চেষ্টায় এখন অবধি অর্ধেক কমিটিও করতে পারেনি দলটি।

একই পথে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আটকের আগে পরে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এখন ছাত্রদল চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কমিটি না হওয়ায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় একজন সহ-সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সব কিছু ভাই থমকে আছে। আমাদের সভাপতি-সেক্রেটারি জেলে। নেত্রীও জেলে। অথচ সবাই যখন মুক্ত ছিলেন তখন অনেকবার কমিটি হওয়ার গুঞ্জন শুনেছি।’

‘কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে কতদিন থাকতে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এরমধ্যেও কর্মসূচিতে থাকার চেষ্টা করছি।’

একই অবস্থা যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলে। আংশিক কমিটি দিয়ে চলছে সংগঠন। খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে ব্যস্ত থাকার কথা বলেও সংগঠন দুটোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সবকিছু চলছে। আমরা স্থবিরতা দেখছি না। তবে চেয়ারপারসন বাইরে থাকলে যেমন পরিস্থিতি থাকত এখন কিছুটা অন্যরকম এটা ঠিক। যদিও এই অবস্থা বেশিদিন থাকবে না।’

খালেদা জিয়ার বন্দি অবস্থা আরো দীর্ঘ হলে কি হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে। চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ আছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তাই সমস্যা হওয়ার কিছু নেই ।’

নতুন কৌশলের খোঁজে বিএনপি

দলের শীর্ষ নেতারা মনে করেন মনে করেন, খালেদা জিয়ার কারাবাস যে দীর্ঘ হবে, তা আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া তাঁর জামিন স্থগিত হওয়ার পর আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই চলমান শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির পাশাপাশি দলীয় প্রধানের মুক্তি কীভাবে ত্বরান্বিত করার যায় সে নিয়ে সোমবার বৈঠক করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

বৈঠকে অংশ নেয়া কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিগগিরই জোট শরিকদের নিয়ে একটি বৈঠক করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে একটি যৌথসভা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ও দলের নেতাদের সঙ্গে যৌথসভা শেষে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে নতুন কোনো কর্মসূচি ঠিক করা হতে পারে বলেও জানান ওই নেতা।

ওই নেতা বলেন, ‘সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে সরকার আমলে নিচ্ছে না। আবার কঠোর কর্মসূচি দিয়েও সরকারের ফাঁদে পা দেয়া ঠিক হবে না। যে কারণে আলাপ আলোচনা করে নতুন কৌশল ঠিক করা হবে।’

সবশেষ খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন তরান্বিত করতে এবং নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে মঙ্গলবার ৭৫টি সাংগঠনিক জেলায় নেতারা সফরে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী ১০ এপ্রিল এই সাংগঠনিক সফর শেষ করার চিন্তাও করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment