১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস

মুফতী মুহা : আবু বকর বিন ফারুক।।
——————————————
১৭ রমজান ইসলামের ইতিহাসে সত্য – মিথ্যার পার্থ্যকের দিন।  ৬২৪ ঈসায়ী সালের ১৩ মার্চ হিজরী দ্বিতীয় সালের ১৭ রমজান মুসলমানদের এক স্বরণীয় দিন।
মুসলমানদের মাত্র ৩১৩ জন মুজাহিদ, কাফেরদের ১ হাজার বিশাল সৈন্যদের মোকাবেলায়, মহান আল্লাহ তা’য়ালার সাহায্য পেয়ে বিজয় লাভ করে।
পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরে কুরআনের বিধান চালু করার জন্য রাসূল (সা.) অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে ইকামতে দ্বীনের কাজ করে যাচ্ছিলেন। মক্কী জীবনের ১৩টি বছর বিরুদ্ধবাদীদের নির্মম অত্যাচারের পরও তিনি থেমে যাননি। অবশেষে আল্লাহর ইচ্ছায় দীর্ঘতম দুঃখের নিশির অবসান হয় এবং আল্লাহর নবী তাঁরই নির্দেশে মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যান। সেখানে কুরআনের ছাঁচে গঠন করেন সর্বজাতির সহাবস্থানে একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র। গড়ে তুলেন অসত্য, অন্যায়, শিরক, কুফর ও বাতিলের বিরুদ্ধে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। কিন্তু মক্কার অবিশ্বাসী বিরুদ্ধবাদীদের কাছে এ এক অসহনীয় ব্যাপার হয়ে উঠল। তারা এটা সহ্য করতে পারল না। তারা আল্লাহর একত্ববাদ ও সার্বভৌমত্ব কায়েমের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। এ শিশু রাষ্ট্রের মূলেই কুঠারাঘাত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল।
তারা মদিনার সীমান্তে বারবার নাশকতামূলক কার্যকলাপ, লুটতরাজ, সম্পদ বিনষ্ট করে একটি অস্বস্তিকর ও উত্তেজনাময় অবস্থার সৃষ্টি করতে লাগল। এমনকি তারা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক হীন ষড়যন্ত্র শুরু করে ও রণ সম্ভারে মজবুতি অর্জনে লেগে পড়ে। অতঃপর সে সিরিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওনা হয়।
 রাসূল (সা.) এ সংবাদ পেয়ে মক্কা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে সিরিয়ার পথে ‘বদর’ নামক স্থানে ৮ রমযান সোমবার রাতে সিয়াম পালনকারী তিন শতাধিক মর্দে মুজাহিদকে নিয়ে উপস্থিত হন। এদিকে চতুর আবু সুফিয়ান মক্কার নবীদ্রোহীদের মিথ্যা খবর রটিয়ে দিল, তারা মুসলমানদের কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে।
 তাই আবু জেহেলের নেতৃত্বে মক্কার ১ হাজার বিরুদ্ধবাদী সৈন্য রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৭ রমযান ভোরবেলা তারা মুসলমানদের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। রাসূল (সা.) সিজদায়ে অবনত হয়ে রাব্বুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ করলেন, ‘হে আল্লাহ! আজ যদি এই মুষ্টিমেয় মুসলিম বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তোমার ইবাদত করার মতো এ পৃথিবীতে আর কেউ থাকবে না।’ আল্লাহ এ প্রার্থনা কবুল করলেন এবং ৩ হাজার ফেরেস্তা দিয়ে সাহায্য করলেন। রোজাদার মুসলিম মুজাহিদদের বীরত্ব ও ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে ইসলামের বিজয় পতাকা পৃথিবীর আকাশে উড্ডীন হয়েছিল আজকের এই দিবসে মাহে রমযানেই।
স্বদেশ-স্বজাতির মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় বিদ্রোহীদের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত প্রতিরোধেই এ বদর যুদ্ধ জরুরি ছিল। তাই এ যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের অস্তিত্বের লড়াই। নিজেদের ভূখণ্ডে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামের অপর নাম বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়। ইসলামে আক্রান্ত হলেই যুদ্ধ করার অনুমতি রয়েছে। কোনোভাবেই আগে আক্রমণ ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। অন্যায়ভাবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে তুচ্ছ বিষয়ে যুদ্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হওয়া ইসলামের শিক্ষা নয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ মাড়িয়ে কোথাও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেবল সশস্ত্র যুদ্ধে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নজির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অথচ আজ দুনিয়াজুড়ে ইসলামের নামে কুচক্রীরা সশস্ত্র ও হিংস্র পন্থায় ‘জিহাদ’ শুরু করেছে। অথচ এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে ‘জিহাদ’ বলার সুযোগ নেই।
 সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হ’ল বিজয়ের মূল হাতিয়ার। পরামর্শ সভায় কয়েকজন ছাহাবী বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলে আল্লাহ ধমক দিয়ে আয়াত নাযিল করেন (আনফাল ৮/৫-৬)। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর গায়েবী মদদ লাভই হ’ল বড় বিষয়। স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতা মন্ডলী পাঠিয়ে সরাসরি সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধের শুরুতে রাসূলের বালু নিক্ষেপের মাধ্যমে (আনফাল ৮/১৭) অতঃপর ফেরেশতাদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছিল (আনফাল ৮/৯)।
বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)।
এ যুদ্ধে মুশরিক বাহিনীর ২৪ জন সর্দারের লাশ একটি নোংরা কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এ যুদ্ধে ২ জন আনসার কিশোর সহোদর হযরত মায়াজ (রা.) ও হযরত মোয়াজ (রা.) আবু জেহেলকে হত্যা করে। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) আবু জেহেলের মাথা কেটে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে হাজির করেছিলেন।
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শহীদ হয়েছিলেন, আর মুশরিক বাহিনীর ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছিলেন। আর এরা ছিল গোত্রসমূহের সর্দার এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ জেহাদে ইসলাম ও রাসূল (সা.)-এর চরম ১৪ জন শত্রুর মধ্যে আবু জেহেল, উৎবা ও শায়বাসহ ১১ জনই জাহান্নামে পৌঁছে যায়। যুদ্ধ শেষে বদর প্রান্তরে নিয়ম অনুয়ায়ী ৩ দিন অবস্থান শেষে চতুর্থ দিনে রাসূল (সা.) মদিনার পথে যাত্রা করলেন।
বদর  জিহাদে  উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে বদর জিহাদের  অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের সাহাবীগণের মধ্য থেকে নেতৃত্বদানকারী ছিলেন হযরত ওমর (রা.), হযরত আলী (রা.) ও হযরত আমীর হামযা (রা.)।
কাফেরদের মধ্যে নেতৃত্বে ছিলেন আবু জাহেল, উৎবা, শায়বা ও পতাকাবাহী নযর ইবনে হারেশ, ওয়ালিদ বিন মুগিরা আবু সুফিয়ান।
সাহাবাগনের (রা) পক্ষ থেকে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী সাহাবী ছিলেন হযরত সা’দ ইবনে ওয়াক্কাস (রা.)। বদর জেহাদে অংশ নেয়া সাহাবী (রা.) মধ্যে ২ জন ছিলেন উষ্ট্রারোহী ৮০ জন তলোয়ারধারী এবং অবশিষ্টগণ হচ্ছে তীর বা বর্শাধারী। এ জেহাদে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে সাহায্য প্রদান করেন। এ জেহাদের পূর্বরাতে কাফেরদের কোন কোন নেতা কোন কোন স্থানে নিহত হবেন রাসূল (দ.) উনার গায়েব নামক মোজেজা। জেহাদের পূর্বরাতে বদর প্রান্তরে প্রবল বৃষ্টির কারণে কাফেরদের এলাকা কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে পড়া। সাহাবগনের বালুময় অবস্থান স্থল বৃষ্টির কারণে জমে গিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া এবং পানি সংগ্রহের সুযোগ পাওয়া। গায়েবীভাবে খেজুরের ডাল তলোয়ারের মতো ধারালো হওয়ায় তা দ্বারা কাফেররা কতল হওয়া।
আমরা যদি আজও বদরের শিক্ষা নিয়ে সামনে আগাতে পারি, তাহলে মহান আল্লাহ তা’য়ালার সাহায্য আমরা পাব। তাই মহান আল্লাহ তা’য়ালার হুকুম মত রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে আউলিয়ায়ে কেরামের বাতানো পথে চলে আমাদের আমলী জিন্দেগী গঠন করি।
বর্তমানে জিহাদের নামে চলছে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ। ইহা ইসলাম সমর্থন করেনা। একজন মুসলমান বোমা মেরে নিজে মরে অন্যকে মারে আর মনে করে
জান্নাতে চলে যাবে ইসলাম ইহা বলেনা। এজন্য আমাদের প্রয়োজন আউলিয়ায়ে কেরামের সোহবতে চলা।
বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাবো এ দেশে ইসলামের পতাকা উড়িয়েছেন আউলিয়ায়ে কেরাম। হযরত শাহ জালাল, শাহ পরান, ছারছীনার আল্লামা নেছারুদ্দীন আহমদ (রহ:), আবু জাফর মো: ছালেহ (রহ:) সহ একদল পীর মাশায়েখ আউলিয়ায়ে কেরাম। তাই তাঁদের বাতানো পথে চললে আমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হব।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুক। আমিন।
লেখক : মুফতী মুহা : আবু বকর বিন ফারুক।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment