মরূদ্যানেও মিরপুর

খেলা শুরুর আগেই গ্যালারির দুই-তৃতীয়াংশের দখল নেওয়া বাংলাদেশি দর্শকদের সিংহভাগের গায়ে শোভা পেয়েছে জাতীয় দলের জার্সি কিংবা জাতীয় পতাকা। তবে পতাকা হাতে স্টেডিয়ামমুখী স্রোতও কম দৃষ্টি কাড়েনি। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে থেকেই শুরু যে মিছিলের।

এ জায়গাটি যে শুষ্ক, রুক্ষ আর বিরাণভূমি ছিল, তাও খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। অবশ্য দেইরাকে (পুরনো দুবাই) এক পাশে রেখে নিত্য বাড়তে থাকা আকাশচুম্বী অট্টালিকায় সাজা নতুন দুবাইয়ে তবু মরুর উত্কট রূপটা বেরিয়েই থাকে। যেমন বেরিয়ে আছে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের চারপাশেও। স্পোর্টস সিটির একাংশের এ স্থাপনাকে অবশ্য মরূদ্যান না বলেও উপায় নেই কোনো। সেই মরূদ্যানও যেন কাল ঢাকার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামমুখী জনস্রোতের সাক্ষী হয়ে থাকল।

শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের সঙ্গে মাশরাফি বিন মর্তুজা টস জিততে না জিততেই যেন গমগম করে উঠল পুরো স্টেডিয়াম। কারা করল? কারা আবার! এই সংযুক্ত আরব আমিরাতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের শ্রমজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির বড় অংশ। মাশরাফি বিন মর্তুজার তাই মনে না হয়ে পারেই না যে তিনি মিরপুরের ‘হোম অব ক্রিকেট’-এ টস করতে নেমেছেন।

টসের সময় থেকে সেই যে শুরু, এরপর বাংলাদেশ দলের উত্থান-পতনের সঙ্গেই যেন বদলাতে থাকল স্টেডিয়ামের চিত্র। কখনো বেদনায় নীরব হলো তো আবার কখনো আনন্দে দুলেও উঠল। ২৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে চোখ মেললেই বোঝা যাচ্ছিল যে সেখানে বাংলাদেশি সমর্থকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাজেই লাসিথ মালিঙ্গার প্রথম ওভারেই লিটন কুমার দাশ ও সাকিব আল হাসান ফিরে যেতেই যেন সুনসান স্টেডিয়াম। যেমনটি মিরপুর কিংবা বাংলাদেশের যেকোনো স্টেডিয়ামেই মাশরাফিদের বিপর্যয়ের সময়ে হয়ে থাকে।

সেসব জায়গার মতো দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামও একসময় জেগে উঠল। সেটি সবচেয়ে বেশি হলো মুশফিকুর রহিম ও মোহাম্মদ মিঠুনের ১৩১ রানের পার্টনারশিপের সময়। যেকোনো বাউন্ডারি বা ছক্কায় গগনবিদারী চিৎকার তো শোনা গেলই, এমনকি মালিঙ্গার বলে আউট ঘোষিত রুবেল হোসেন রিভিউতে বেঁচে যাওয়ার পরও। খেলা শুরুর আগেই গ্যালারির দুই-তৃতীয়াংশের দখল নেওয়া বাংলাদেশি দর্শকদের সিংহভাগের গায়ে শোভা পেয়েছে জাতীয় দলের জার্সি কিংবা জাতীয় পতাকা। তবে পতাকা হাতে স্টেডিয়ামমুখী স্রোতও কম দৃষ্টি কাড়েনি। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে থেকেই শুরু যে মিছিলের।

দুপুরের তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে হৈহৈ-রৈরৈ করে স্টেডিয়ামের দিকে এগোচ্ছিল একেকটি দল। তাও আবার ততক্ষণে দুবাইয়ের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলেছে বলে জানাচ্ছিল অ্যাকু ওয়েদার। আর স্টেডিয়াম থেকে বেশ দূরেই স্টিকারবিহীন গাড়ি থেকে নেমে যেতে হচ্ছিল বলে হেঁটে যাওয়ারও বিকল্প ছিল না। নিজেদের দলের জার্সি পরে পতাকা নিয়ে বাংলাদেশি সমর্থকদের ঢলকে এ কারণেই আরো জমকালো এবং আকর্ষণীয় দেখাল বেশি। সাজানো-গোছানো নান্দনিক স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচকে তারা আরো রঙিন করে তুললেও এখানে অব্যবস্থাপনার নজিরও আছে বেশ কিছু।

এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) টুর্নামেন্টের আয়োজক; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক মানের নয়। এরই একটি নমুনা কাল ম্যাচ শুরুর পর। আন্তর্জাতিক ম্যাচে টসের পরপরই দুই দলের টিম লিস্ট প্রেস বক্সে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু মালিঙ্গার করা প্রথম ওভারেই দুই উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়ার পর শোনা গেল কেউ একজন বলছেন, ‘বাংলাদেশের টিম লিস্ট লাগবে কার কার?’ অবশ্য বাংলাদেশের সাংবাদিকদের হ্যাপাটা সবচেয়ে বেশি পোহাতে হয়েছে আগের দিন। যেকোনো ম্যাচের আগেই ম্যাচপূর্ব একটি সংবাদ সম্মেলনের ব্যাপার থাকে। তাও আবার এটি ছিল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচ। কিন্তু এসিসি আয়োজন করল কী? ছয় দলের অধিনায়কদের নিয়ে একটা সংবাদ সম্মেলন, যেটি গত্বাঁধা কিছু প্রশ্নের পরই শেষ। পরে বোঝা গেল স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে ট্রফি নিয়ে অধিনায়কদের ছবিই মুখ্য উদ্দেশ্য।

তাতে এই এশিয়া কাপ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিকরাই পড়লেন সবচেয়ে বেশি ঝামেলায়। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন ছিল না বলে ঘুরপথে অধিনায়ক মাশরাফিকে ধরার চেষ্টা। দলের সঙ্গে মিডিয়া ম্যানেজার নেই বলে ভরসা ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ। কিন্তু ততক্ষণে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার (বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা) অনুশীলনে বাংলাদেশ দল আবার চলে গেছে যেখানে, এ মরুর বুকে সেই আইসিসি ক্রিকেট একাডেমিও খুব কাছে নয়। কালকের মরূদ্যানমুখী বাংলাদেশি সমর্থকদের মিছিলও হাঁটা ধরেছিল সেই অনেক দূরে নেমে গিয়েই। যাদের ভিড়ে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল নিয়েছিল একদম মিরপুরের সজ্জা!

 

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment