ধর্ষণের ঘটনা তদন্তে ১৮ দফা নির্দেশনা: পালন করবে কে?

নিউজ ডেস্ক : ধর্ষণের অভিযোগ দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভুক্তভোগীর ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোসহ হাইকোর্টের দেওয়া ১৮ দফা নির্দেশনা পালনে প্রায় একবছরেও সরকারের পক্ষ থেকে পৃথক কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও ধর্ষণের মামলা দায়ের ও তদন্ত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নারীনেত্রীরা বলছেন, এধরনের নির্দেশনার পাশাপাশি দরকার সংবেদনশীল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তা না হলে আইন, নীতিমালা সব কাগজে কলমে রয়ে যাবে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।

রাজধানীতে এক গারো তরুণীকে গণধর্ষণের মামলায় ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ধর্ষণের মামলা ও তার তদন্ত বিষয়ে ১৮ দফা নির্দেশনা দেন। এরপর গতবছর মে মাসে দুই বিচারপতির স্বাক্ষর শেষে ৪০ পৃষ্ঠার এই রায় প্রকাশ করা হয়। আইন না হওয়া পযন্ত এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলার নির্দেশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে উদ্দেশ করে দেওয়া হলেও আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কেউই এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের কোনও উদ্যোগ নেয়নি।

আদালতের নির্দেশনাগুলোয় বলা হয়েছে, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ সংক্রান্ত ঘটনায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিখিতভাবে রেকর্ড করবেন। এক্ষেত্রে ওই থানার আওতার মধ্যে ঘটনাটি সংঘটিত হোক বা না হোক, সেটা মুখ্য নয়।

রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের কাছে এ ধরনের কোনও নির্দেশনার বিষয়ে আলাদা করে কিছু জানানো হয়নি।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনা যে থানার সেখানেই রেকর্ড হওয়া উচিত। যদি ঘটনাস্থল ভিকটিমের আবাসস্থল থেকে দূরে হয় সেক্ষেত্রে তারা এজাহার নিতে পারেন, পরে সেই এজাহার সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

রাজশাহীর রাজপাড়া ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মাইদুল ইসলামকে প্রশ্ন করা হয় ৫ কিলোমিটার দূরের রাণীবাজারের কোনও ঘটনার ভিকটিমকে যদি রাজপাড়া থানা এলাকায় উদ্ধার করা হয় তাহলে এই থানাতেই মামলা করা যাবে কিনা। তিনি উত্তরে বলেন, রাণীবাজার বোয়ালিয়া থানার অধীনে। যদি দূরত্ব আরও বেশি হতো তাহলে নেওয়া যেতে পারে। তবে যেখানে ঘটনা সেখানে মামলা করাই ভালো। বিকটিম বা তার পরিবার যদি আপনার থানায় মামলার উদ্দেশ্যে আসে তাহলে মামলা নেবেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, সিনিয়রদের সঙ্গে পরমর্শ করে দেখতে হবে।

খুলনার দৌলতপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী মোস্তাক আহমেদ (সিপিএম) একই ধরনের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এরকম কোনও নিয়ম নেই। যার এলাকায় ঘটনা ঘটবে সেখানে মামলা হবে। আমাদের কাছে এজাহার দিলে আমরা ফরওয়ার্ড করতে পারি।

সিলেটের শাহ পরান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকতার হোসেন সরাসরি পারা যাবে না জানিয়ে বলেন, অন্য স্থানের ঘটনা হলে আমি মামলা নিতে পারবো না। যে কোনও থানায় মামলা করতে পারবে এমন নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেখানে ঘটনা ঘটবে সেই থানায় মামলা করতে হবে।

চট্টগ্রামের চকবাজার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ঢাকা থেকে এসে কেউ চট্টগ্রামে ধর্ষণের শিকার হলে মামলাটি নেওয়া যাবে। কিন্তু শহরেরই এক থানা থেকে আরেক থানার মামলা নেবো কেন? কেননা কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও ঘটনার থানায় মামলা না করে কেন অন্য থানায় মামলা সেটি নিয়ে বিচারের সময় সন্দেহ দেখা দেবে। ঘটনা যেখান থেকে শুরু এবং যেখানে শেষ ঘটনা দুই জায়গাতেই মামলা হতে পারে, যত দ্রুত মামলা সম্ভব সেটিই মুখ্য।

হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন-১ ও দুই অধিশাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ধর্ষণ তদন্তের জন্য কোনও নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আইন-১ শাখায় খোঁজ নিয়ে শাখা থেকে বলা হয় এটি আইন-২ শাখার কাজ।

আইন-২ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলাউদ্দিন জানান, এ ধরনের উদ্যোগের বিষয়ে কোনও নথি নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা আইন এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকেও কোনও নথি উত্থাপিত হয়ে আমার কাছে আসেনি।

পুলিশ রিফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন নারী অধিকারকর্মী ফৌজিয়া খন্দকার। তিনি বলেন, আমরা জেন্ডার সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু এতো স্তরের কর্মকর্তারা আছেন, এই কাজ ধারাবাহিকভাবে চলমান থাকা দরকার। ধর্ষণের ঘটনায় কীভাবে তদন্ত হবে এ নিয়ে এর আগেও অনেক ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেন্ডার সংবেদনশীল হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ হয়েছে। কিন্তু সার্বিক পরিবর্তন আনা এখনও সম্ভব হয়নি। হাইকোর্টের এই নির্দেশনা যদি থানায় থানায় পাঠানোর ব্যবস্থা হয় তাহলে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

হাইকার্টের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে—সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ অফিসার যদি অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব করেন, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে। প্রত্যেক থানায় কনস্টেবলের নিচে নয়, এমন একজন নারী পুলিশ রাখতে হবে। অভিযোগ পাওয়ার পর ডিউটি অফিসার একজন নারী কর্মকর্তার (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাধ্যমে ও ভুক্তভোগীরপরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমাজকর্মী বা আইনজীবীর উপস্থিতিতে অভিযোগ রেকর্ড করবেন। সবক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সমস্ত তথ্য সংরক্ষণে গোপনীয়তা রক্ষা করার নির্দেশনাসহ প্রত্যেক থানায় ভুক্তভোগীদের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ নারী-সমাজকর্মীদের একটি তালিকা তৈরি রাখার কথা বলা হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment