‘বাজান আর কত অপেক্ষা? জমি জিরাত দিলাম বিনা পয়সায়, জমির উপর রাস্তার জন্য বালু ফালাইলো, ব্রিজের পিলারও বানাইলো, ব্রিজতো বানাইলো না। বয়সতো কম হইলো না। একশত পার হয়েছে। এখন পরপারে যাবার পালা।
মরার আগে বালু নদের উপর ব্রিজটা দেখে যাওয়ার বড়ই স্বাধ আছিলো গো বাজান। মনে হয় তা আর পূরণ হবে না।’ মনের ক্ষোভে কথাগুলো বলছিলেন খামারপাড়া এলাকার আব্দুর রহমান ভুইয়া।
বালুরপাড় এলাকার হাফিজ উদ্দিন বলেন, বালু নদের ব্রিজ নিয়ে এখন ভানু-মতির খেলা শুরু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ বলে ব্রিজ ঢাকা করবে আর ঢাকা বলে নারায়ণগঞ্জ করবে সেতুর কাজ। এভাবেই চলে গেল ১৬ টি বছর। কার কোন অদৃশ্য ইশারায় বন্ধ হয়ে আছে বালু নদের ব্রিজের কাজ তা স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানতে চান।
বালু নদের ওপর স্বপ্নের সেতু নির্মাণ হবে এ আশায় বুক বেঁধে আছে স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তারা।
এ সেতু হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের বালুরপাড়, ইদারকান্দি, ফকিরখালীসহ ১৫টি গ্রাম ও রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের যোগাযোগ সহজ হবে। আর সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে দায়িত্ব এড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, প্রস্তাবিত রামপুরা-কায়েতপাড়া সড়কের বালু নদে সেতুর অনুমোদন হয় ২০০১ সালে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের (নারায়ণগঞ্জ এলজিইডি) অধীনে এ সেতুর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে।
পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধানে এক বছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেয়া হয় একটি ঠিকাদার কোম্পানিকে। পরবর্তীতে একবার বরাদ্দও দেয়া হয়েছিল।
এতে সেতুটির ২টি স্প্যান নির্মাণ করে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় জাহিদ নামে ওই ঠিকাদার। আরও জানা যায়, নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেতুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে নতুন করেও বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।
সেতুটির বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবদুস সাত্তার বলেন, বালু নদের ওপর নির্মাণ কাজ থেমে থাকা সেতুটির দায়িত্ব বর্তমানে সড়ক বিভাগের কাছে নেই। বর্তমানে সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্নের বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগ বলছে কায়েতপাড়ায় বালু নদের ওপর সেতুটির কাজ শেষ করবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় (নারায়ণগঞ্জ-এলজিইডি)। আর নারায়ণগঞ্জ এলজিইডি বলছে ওই সেতুটির কাজ তারা এখন করবে না। এটির দায়িত্ব বর্তমানে ঢাকা এলজিইডির অধীনেই সম্পন্ন হবে।
তবে ঢাকা জেলা এলজিইডি বলছে খিলগাঁও থানা এলাকা সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত বলে, সেতুটিতে তাদের করার কোনো এখতিয়ার নেই। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলছে, যেহেতু সেতুটি আগেই নির্মাণ শুরু করেছে কোনো কর্তৃপক্ষ সেহেতু সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এটি আনা সম্ভব নয়। সেতুটির কাজ শুরু না হলে এটির বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে প্রস্তাব পাঠানো যেত।
প্রকৃতপক্ষে এ সেতুর বিষয়ে সংশ্লিষ্টকোনো কর্তৃপক্ষই যেন দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। তাই ভুক্তভোগীদের আশার আলো যেন দ্রুত নিভে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সেলিম সরকার বলেন, কাজ বন্ধ থাকা বালু নদের ওই সেতুটি আমাদের করার কথা জানতে পেরে খোঁজ নিয়েছি। পরে জানা গেছে এটি এখন নারায়ণগঞ্জ এলজিইডি করবে না। এটি হয়তো ঢাকা জেলা এলজিইডি করবে।
ঢাকা জেলা এলজিইডির এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মো. মোশারফ হোসেন বলেন, বালু নদের ওপর সেতুটি নির্মাণ কাজ শুরু করা বিষয়ে ঢাকা জেলা এলজিইডি দায়িত্ব নিতে পারবে না। এর কারণ সেতুটির একপাশে রূপগঞ্জ ও আরেক পাশে ডিএসসিসির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড।
বালু নদের ওপর সেতুটি নির্মাণ কাজ শেষ হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড ও রূপগঞ্জের বাসিন্দারা সহজে নগরীতে যেতে পারবে। পাশাপাশি সেতুকেন্দ্রিক সড়কবিহীন গ্রামেও পরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ হবে।
রূপগঞ্জ ও ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলে প্রত্যন্ত ওই ১৫ গ্রামেও অভ্যন্তরীণ পরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ হতো। এতে করে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নবাসী ও নাসিরাবাদবাসীরা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকার রামপুরায় যেতে পারবেন।
অথচ অজ্ঞাত কারণে সেতুটির নির্মাণ কাজ আজও বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি বনশ্রী থেকে খিলগাঁওয়ের কায়েতপাড়া হয়ে রূপগঞ্জ সংযোগ সড়কের প্রায় ৫ কিলোমিটার সড়ক এখনও অনির্মিতই রয়ে গেছে।
গত ৮-১০ বছর আগে ফসলি জমির ওপর দিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার মাটি ফেলে রাস্তা দৃশ্যমান করা হয়েছে। এ সড়কটিতে ২টি কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও হঠাৎ রাস্তার কাজও বন্ধ হয়ে যায়।
সেতু সংলগ্ন বালুরপাড় গ্রামের বাসিন্দা ইকবাল দেওয়ান বলেন, আমরা এখনও নড়াই নদের মাধ্যমে নাসিরাবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন ১৫টি গ্রামের মানুষ। বালু নদের এ সেতুটিই আমাদের স্বপ্ন।
এ সেতুটি হলে ১৫ গ্রামেও রাস্তা হয়ে যেত। আমরা এখনও নৌকায় চলি। সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় নগরীর প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।