এবার পেট ভাড়া

মাদককারবারিরা ইয়াবা পাচারে নতুন কৌশল নিয়েছেন। ভাড়া করছেন পেট। নারী ও পুরুষ এমনকি শিশুর পেট ভাড়া নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন ইয়াবার চালান। টাকার বিনিময়ে নিজের পেটে প্যাকেটভর্তি হাজার হাজার ইয়াবা পাচারে বাহকদের কেউ কেউ সফল হচ্ছেন। অনেকে প্রাণও হারাচ্ছেন।

রাজধানীতে সম্প্রতি রিপা বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ নারীর লাশের ময়নাতদন্তের পর তার পেট থেকে ৫৭টি প্যাকেটে মোড়ানো দেড় হাজার পিস ইয়াবাবড়ি উদ্ধারের ঘটনায় বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। গতকাল শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে জুলহাস মিয়া (৩২) নামে এক ব্যক্তির দেহেও মিলেছে বিপুল ইয়াবা ট্যাবলেট।

১ এপ্রিল দুপুুরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের গেটে পেটে ইয়াবা বহন করা কক্সবাজারের উখিয়ার বাসিন্দা রিপার লাশ ফেলে যায় বাড্ডা থেকে সিএনজি অটোরিকশায় আসা এক যুবক ও বোরকা পরিহিত দুই নারী। গত শুক্রবার ভোরে মতিঝিল থানাধীন কমলাপুর মসজিদের পাশের রাস্তায় জুলহাস মিয়াকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।

মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে ময়নাতদন্তের সময় জুলহাসের পেট থেকে ১১ পোটলা ইয়াবা উদ্ধার করেন চিকিৎসকরা। জুলহাসের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, মতিঝিল থেকে নিয়ে আসা জুলহাস নামের ওই ব্যক্তির মরদেহের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।

তারপরও অচেনা কোনো লাশের ময়নাতদন্তের করার নিয়ম রয়েছে। মতিঝিল থানাপুলিশ জুলহাসের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্তের একপর্যায়ে জুলহাসের পেটে স্কচটেপ মোড়ানো ১১টি প্যাকেট পাওয়া যায়। পরে ওই প্যাকেট খুলে দেখা যায় প্রত্যেকটিতে রয়েছে ২০-২৫ পিস করে ইয়াবা। এর মধ্যে কয়েক প্যাকেট ইয়াবা গলে গেছে।

মূলত গলে যাওয়া ইয়াবার বিষক্রিয়ায় জুলহাসের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইয়াবাগুলো পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। ওই রিপোর্ট এলে তার মৃত্যুর কারণ জানা যাবে বলেও জানান ডা. সোহেল মাহমুদ। মতিঝিল থানার এসআই মনজুরুল হাসান খান জানান, শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মতিঝিলের বিশ্বাস টাওয়ারের সামনে অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন জুলহাস।

এ সময় লোকজন তার মাথায় পানি ঢালছিল। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর জুলহাসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী তার ভাই ও স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তাদের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আক্কাস মিয়া। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন মারা যান জুলহাস। এরপর তার পরিবারের সদস্যরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নেওয়ার চেষ্টা করে।

বিষয়টি রহস্যজনক মনে হওয়ায় পুলিশ অনুমতি না দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ করেন। ময়নাতদন্তের জন্য সন্ধ্যায় লাশ ঢামেক হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে বলেও এসআই মনজুরুল জানান। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে নিহত জুলহাসের ছোট ভাই মেহেদী হাসান সোহাগ গতকাল ঢামেক হাসপাতাল মর্গে আসেন। তিনি গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালের টেকনিশিয়ান।

মেহেদী জানান, তার ভাই দেশে কাঠের ব্যবসা করতেন। গত রবিবার গ্রাম থেকে ঢাকার মিরপুরে আসেন। তিনি মিরপুরের একটি বাসায় উঠেছেন। গত বুধবার তার পরিবারের সঙ্গে কথা হলে চকবাজারে আছেন বলে জানান জুলহাস। দুই-একদিনের মধ্যেই মেহেদীর সঙ্গে দেখা করতে গাজীপুর যাওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন। এর পরই বাড়িতে ফেরার কথা ছিল জুলহাসের। ২৪ এপ্রিল ভাইয়ের সঙ্গে শেষবার কথা হয় মেহেদী হাসানের।

এর পর পুলিশের মাধ্যমে জুলহাসের মৃত্যুর খবর পান তিনি। তবে জুলহাস কি কারণে ঢাকায় এসেছিলেন তা জানেন না বলে দাবি করেন মেহেদী। মতিঝিল থানার ওসি ওমর ফারুক জানান, পেটের ভেতরে প্যাকেটে ইয়াবা পাচারের বেশ কয়েকটি ঘটনা আগেও ধরা পড়েছে। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে এক নারী লাশের পেটেও বিপুল পরিমাণে ইয়াবা পাওয়া গেছে।

তাই ধারণা করা হচ্ছে, পুলিশের অভিযান ও সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন বেছে নিয়েছেন মানুষের পেট। বিষয়টি খুবই শঙ্কার। ধারণা করা হচ্ছেÑ নিহত জুলহাস মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে নেত্রকোনা সদর থানায় একটি এবং আটপাড়া থানায় একটি মাদক মামলা রয়েছে। পাচারের উদ্দেশে তিনি এসব ইয়াবা বড়ি পেটে বহন করছিলেন।

কারা জুলহাসের পেটে করে ইয়াবা পাচার করছিলেন তা জানতে তদন্ত চলছে। তদন্তের পরই এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। নারী লাশের পেট থেকে ইয়াবা উদ্ধারের বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে জানান, ১ এপ্রিল দুপুরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের গেট থেকে পাওয়া মৃত ওই নারীর নাম রিপা বড়ুয়া।

তিনি সপরিবারে কক্সবাজারের উখিয়ার কড়লিয়া এলাকায় থাকতেন। লাশের পেট থেকে ইয়াবা উদ্ধারের এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেখা যায়। লাশের ময়নাতদন্তের দুদিন পর ফেসবুকে রিপার লাশের ছবি দেখে তার স্বামী রতন বড়–য়া ও ছেলে বিজয় বড়–য়া তাকে শনাক্ত করেন। নিহতের স্বামী রতন স্থানীয় একটি ধানের চাতালে কাজ করেন। তার ছেলে বৌদ্ধ বিঞ্জু।

প্রাথমিক তদন্তে মাদকের কারবারে তাদের সম্পৃক্ততা মেলেনি। তাই রিপার লাশ নিয়ে তাদের চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। রিপার পেটে কীভাবে ইয়াবা এলো, কারা এই চক্রে জড়িত তা জানতে তদন্ত চলছে বলেও পরিদর্শক আবুল কালাম জানান।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment