মৃত্যুর পর বাবার কথাই সত্যি হলো: সুবীর নন্দীর মেয়ে

মৃত্যুর পর বাবার কথাই সত্যি হলো: সুবীর নন্দীর মেয়ে

পঞ্চাশ বছরের সঙ্গিত জীবনে রেডিও, টিভি এবং চলচ্চিত্রে আড়াই হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। গানের জন্য ঢাকার একুশে পদক এবং চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন সুবীর নন্দী।

দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ই মে ভোরে মারা যান একুশে পদকপ্রাপ্ত জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। বয়স হয়েছিল ৬৬।

আজ বুধবার, ৮ মে সকালে দেশে পৌঁঁছেছে তার মরদেহ। জাতির পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বুধবার সকাল ১১টায় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয় সুবীর নন্দীর মরদেহ।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ব্যক্তিত্বসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ।

তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী তপন মাহমুদ, সুবীর নন্দীর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ফকির আলমগীর, রফিকুল আলম, নাট্যব্যক্তিত্ব ড. ইনামুল হকসহ আরও অনেকে। তারা ফুল হাতে এসেছিলেন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে।

এ সময় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাবার মৃতদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সুবীর নন্দীর মেয়ে ফাল্গুনী নন্দীকে। তার চোখের দৃষ্টিতে বাবার হারানোর অসহায়ত্ব। মলিন মুখ। পৃথিবীর সেরা প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে তিনি শোকে কাতর।

তবু গণমাধ্যমের অনুরোধে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে কথা বললেন। ফাল্গুনী বলেন, ‘আমাদের কেউ আর রইলো না। বিশেষ করে আমাকে সারাক্ষণ আগলে রাখতেন বাবা। কলিজার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আমার একটু কষ্ট হলে পাগল হয়ে যেতেন।

আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। কিন্তু আমি যখন চাকরি করতে চাইলাম দিলেন না। বললেন আমার নাকি কষ্ট হবে। এই যে এখন আমাকে রেখে চলে গেলেন আমার এত খেয়াল কে করবে!’

চোখ মুছতে মুছতে ফাল্গুনী আরও বলেন, ‘অবশ্য বাবা জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেছেন। লড়াই করা শিখিয়েছেন। শেষ ২৪টা দিন বাবা জীবনের জন্য মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে সেটা খুব কাছ থেকে দেখলাম। তার এই লড়াই যেন তিনি আমার জন্য শিক্ষা হিসেবে রেখে গেলেন। এখন মনে হয় আমি বাবাকে ছাড়াই একা চলতে পারবো। সব করতে পারবো।’

ফাল্গুনী তার বাবার দেশপ্রেমের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘বাবা এই দেশের প্রেমে অন্ধ ছিলেন। তিনি গর্ববোধ করতেন বাংলাদেশি হিসেবে। একবার তার খুব অসুখ। আমেরিকায় উন্নত চিকিৎসার সব বন্দোবস্ত হলো। তিনি গেলেন। কিন্তু চিকিৎসা শুরুর আগেই হাঁপিয়ে গেলেন। আমেরিকা ছেড়ে চলে এলেন।

আমার কানে এখনো বাজছে তিনি বলেছিলেন- সালাম আমেরিকা। আমি নিজের দেশে ফিরে গেলাম। সেখানে চিকিৎসা নেব। মরলে নিজের মায়ের কোলেই মরবো। তাকে বোঝানো যায়নি। দেশের প্রতি ভালোবাসার তার জেদ আমৃত্যু ছিল।

আমি বলতাম দেশ নিয়ে এত আবেগ কেন তোমার। তিনি বলতেন, ‘‘এই দেশের মানুষ ভালোবাসতে জানে, সম্মান করতে জানে। তিনি বলতেন কথায় কথায়, ‘দেখিস এই দেশ ও দেশের মানুষ তোর বাবাকে সম্মান করবে। এখানে গুণের কদর আছে।’’

আজ বাবার মৃত্যুর পর রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের যে ভালোবাসা আমি দেখছি তাতে বারবার ভাবছি বাবার কথাই তো সত্যি হলো। আজীবন মন থেকে ভালোবাসলে সেটা ফেরত পাওয়া যায়। বাবা পাচ্ছেন। এই দেশ ও দেশের মানুষ তার অুসস্থ হওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হৃদয় উজার করে ভালোবাসা দিচ্ছেন। বাবা সেই ভালোবাসায় শান্তিতে ঘুমাবে।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment