রাজধানীর গ্যাসলাইন পরিবর্তনে ১২শ কোটি টাকার প্রকল্প

রাজধানীর গ্যাস পাইপলাইন পরিবর্তন, গ্যাস নেটওয়ার্কের ত্রুটি সংশোধন এবং নেটওয়ার্ক ডিজিটাল জিআইএস নকশা পরিবর্তন করতে ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকার প্রকল্প নিচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (তিতাস)। তিতাস বলছে, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বা চাপ বাড়বে। গ্রাহকদের গ্যাস প্রাপ্তি নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে, তার অবসান হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্প অপ্রয়োজনীয়। যেহেতু আবাসিক সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং রাজধানী থেকে সব শিল্প-কারখানা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তাই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আব্দুল ওহাব তালুকদার আমাদের সময়কে বলেন, পুরনো পাইপলাইন পরিবর্তন জরুরি। গ্যাস সংকট নিয়ে প্রতিদিন তিতাসে অনেক অভিযোগ আসে। অনেক জায়গায় জরাজীর্ণ পাইপের কারণে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। ফলে পাইপলাইন পরিবর্তন হলে গ্যাস সংকট কমে আসবে। এ ছাড়া পাইপলাইন ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন করা দরকার। আমরা চেষ্টা করছি পাইপলাইন নেটওয়ার্ক ডিজিটাইজ করতে। তিতাস বলছে, গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের সরবরাহ ও চাপ পরিস্থিতি উন্নতি করতে প্রয়োজনীয় ও উচ্চতর ব্যাসের পাইপলাইন দ্বারা বিদ্যমান নেটওয়ার্কের পুরনো, লিকেজযুক্ত ও স্বল্প ব্যাসের পাইপলাইন পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন জরুরি। এ লক্ষ্যে সমগ্র ঢাকা শহরকে ১৪৩টি গুচ্ছ এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে। এখান থেকে প্রথমে ৬০টি এলাকার স্বল্প চাপ সমস্যা এবং পুরনো ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন বা স্বল্প ব্যাসের পাইপলাইন পরিবর্তন করা হবে। পর্যায়ক্রমে তিতাসের আওতাধীন বাকি এলাকাগুলোর নেটওয়ার্ক উন্নীতকরণে কাজ করা হবে। তবে শুধু নেটওয়ার্ক নয়, তিতাসের নেটওয়ার্ক ম্যাপিং বা নকশা সংরক্ষণের বিষয়টিকেও আধুনিকায়ন করতে এ প্রকল্প নিতে চায় তিতাস। কোম্পানির যাবতীয় নকশাকে জিআইএস বা ডিজিটাল করতে প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দিতে চায়। 

বিদ্যমান নেটওয়ার্ককে বর্তমানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্মার্ট ম্যাপিং তথা স্ক্যাডার সঙ্গে যুক্ত করার নেটওয়ার্কটি ডিজিটাল করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিতাস মনে করছে। তিতাস দুটি এলাকার বিদ্যমান নেটওয়ার্ক পর্যালোচনা করে বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে আনুমানিক ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা লাগবে। তবে এ খরচ বাড়তেও পারে। তিতাস এ প্রকল্প কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী। তবে এই কাজাকে তিতাস টেন্ডার প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে ডিপিএম মেথড বা ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডে করতে চায়। সূত্রে জানা যায়, তিতাস বলছে ডিপিএম মেথডে কাজটি তুলনামূলকভাবে কম সময়ে সম্পন্ন করা যাবে এবং দীর্ঘমেয়াদি সেবার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। মূলত উন্মুক্ত টেন্ডার প্রক্রিয়া এড়িয়ে যেতেই তিতাস প্রকল্পটি ডিপিএম মেথডে করতে চায় বলে তিতাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান। তিতাস প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)’ প্রণয়নের মাধ্যমে কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে সিস্টেম উন্নয়ন ও সমন্বয় খাত থেকে সংকুলান করতে চায়, যার মাধ্যমে ধাপে ধাপে কাজটি করতে হবে। তিতাসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে তিতাসের পাইপলাইন নেটওয়ার্কের যে অবস্থা, তা বিস্তৃত জালের মতো। অগিগলি মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন জালের মতো ছড়িয়ে আছে। অনেক এলাকার পাইপলাইনের সঠিক নকশাও নেই তিতাসের কাছে। দিনের পর দিন ঠিকাদাররা তিতাসের অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় পাইপলাইন স্থাপন করেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, পাইপলাইন নতুন করে স্থাপন করতে গেলে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তাঘাট কাটতে হবে। ফলে এ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা জটিল। যেহেতু আবাসিক সংযোগ বন্ধ, শিল্প-কারখানা ঢাকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, এলপিজি বা বোতলজাত সিলিন্ডার গ্রাহকদের দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে এই ঢাকা শহরের পাইপলাইন পরিবর্তন বাস্তবসম্মত নয়। তিতাস সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৭ সালে ডেমরা সিজিএস নির্মাণের পর ঢাকা শহরে গ্যাস সরবরাহের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের ৮০-এর দশকের শেষের দিক পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় ৫০ পিএসআইজি বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হয়। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে নির্মিত প্রায় ৩০ ও ৬০ পিএসআইজি এবং আউটলেট ১০ থেকে ৩০ পিএসআইজিতে নেমে আসে। কোম্পানির বিতরণ লাইনগুলো সমান্তরাল কিংবা আড়াআড়িভাবে বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থার ইউটিলিটি লাইন স্থাপনকালে এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা মেরামত, ড্রেন নির্মাণ, ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজে গ্যাস পাইপলাইনের র‌্যাপিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ হয়ে আছে। গ্যাস লিকেজের কারণে অগ্নি দুর্ঘটনা ও অন্য জননিরাপত্তাজনিত কারণে পাইপলাইনের পানি প্রবেশ করে গ্রাহক প্রান্তে গ্যাসপ্রাপ্তি ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তিতাস বলছে, প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২৫টি অভিযোগ আসে তাদের কাছে। এ ছাড়া জাতীয় গ্রিডে এলএনজি থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা শহরে গ্রাহক প্রান্তে গ্যাসের সরবরাহ ও চাপ পরিস্থিতির উন্নীতকরণ জরুরি। বর্তমান ও ভবিষ্যতে চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ও উচ্চতর ব্যাসের পাইপলাইন দ্বারা বিদ্যমান নেটওয়ার্ক পুরনো লিকেজযুক্ত ও স্বল্প ব্যাসের পাইপলাইন পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে ঢাকা শহরের গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য আমিনবাজার, তেজগাঁও, টঙ্গী ও দনিয়া টিবিএস, ডিআরএস থেকে বিদ্যমান বিভিন্ন বিতরণ মেইন লাইনে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সূফি আমাদের সময়কে বলেন, সরকার আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। রাজধানী থেকে শিল্প-কারখানা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে রাজধানীর গ্যাস পাইপলাইন পরিবর্তন একটি অযথা প্রকল্প। তিনি বলেন, রাজধানীর গ্রাহকদের ক্রমান্বয়ে এলপিজি সরবরাহ করে পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ফলে রাজধানীর পাইপলাইন প্রতিস্থাপন বা পরিবর্তনে এ প্রকল্পের কোনো দরকার নেই বলে আমি মনে করি।

আপনি আরও পড়তে পারেন