ভাঙছে জাতীয় পার্টি!

ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। এরশাদের মৃত্যুর সপ্তাহ না পেরুতেই ৬ষ্ঠ বারের মতো ভাঙনের সুর বাজছে দলটির মধ্যে।

সাবেক এ সামরিক শাসক জীবদ্দশায় ৫ বার দলটি ভাঙনের শিকার হয় এবং শেষ মুহূর্তেও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে যান দলটির ভবিষ্যৎ।

এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার চেয়াম্যান পদ নিয়ে আবারো দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছি।

এরশাদের স্ত্রী ও জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান মানতে নারাজ।

অন্যদিকে, জিএম কাদের গঠনতন্ত্র অনুসারেই চেয়ারম্যান হয়েছেন বলে মনে করছেন তার অনুসারীরা।

সময়ের সাথে দূরত্ব বাড়ছে দুটি বলয়ের, যেকোনো সময় দুই ভাগে বিভক্ত হতে পারে দলটি। জাপার একাধিক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে জাতীয় পার্টি। ঐ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়ে।

বড় অংশটিসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ছিলেন এরশাদের পক্ষে আরেকটি অংশ অবস্থান নেয় এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের পক্ষে। এরপর থেকে জাতীয় পার্টি চলছে বলয় দুটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।

ঐ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন রওশন ও তার অনুসারীরা। নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এরশাদ ও তার অনুসারীরা।

এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন এরশাদের দীর্ঘ সময়ের সহযোদ্ধা কাজী জাফর।

এসময় দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রওশনের সঙ্গে না পেরে এরশাদ কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। দশম জাতীয় নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভা সদস্যসহ সব ধরনের সুবিধা নেয় রওশনপন্থিরা।

নির্বাচনের পর বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন নিয়ে এরশাদ-রওশন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এরশাদ বিরোধী দলীয় নেতা হওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। স্ত্রী রওশন এরশাদ বিরোধী দলীয় নেতা হন।

এসব ঘটনার পেছনে সরকারের ইচ্ছা শক্তি বেশি কাজ করেছে বলে জানা গেছে।

জাতীয় পার্টিকে বিভক্ত করার পুরো প্রক্রিয়াটির জন্য নেপথ্য নায়ক হিসেবে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়া উদ্দিন বাবলুকে চিহ্নিত করা হয় দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে।

জাপা সূত্র মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর রওশন এরশাদের প্রতি গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হন এরশাদ। দলীয় নেতাকর্মীদের নিজের পক্ষে রাখতে বেশ কিছু পদক্ষে নেন তিনি।

২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুরের এক কর্মী সম্মেলনে ছোট গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন এরশাদ।

এসময় এরশাদের অবর্তমানে জিএম কাদের জাপার হাল ধরবেন নেতাকর্মীদের জানান তিনি। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রওশন এরশাদ ও তৎকালীন মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুপন্থিরা।

এর পরদিন ১৯ জানুয়ারি সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশনের বাসায় প্রেসিডিয়াম সদস্যের একাংশ বৈঠকে বসেন।

বৈঠক শেষে জিয়াউদ্দিন বাবলু রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। এসময় তিনি বলেন, গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যান বলে কোনো পদ নেই। এটা গঠনতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

পার্টির গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারা বলে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি (এরশাদ) কাউকে ঘোষণা দিতে পারেন না। তার এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের (সোমবার) বৈঠকে উপস্থিত সব সদস্যের সম্মতিক্রমে রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এখন থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চেয়ারম্যান ও জিএম কাদের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ। জিয়াউদ্দিন বাবলুর ঘোষণার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে ঐদিনই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, যারা অবৈধভাবে প্রেসিডিয়াম সদস্যের সভা ডেকেছে তারা দলে থাকবে না।

আমি দলের চেয়ারম্যান, আমি ছাড়া প্রেসিডিয়াম সভা আহ্বান করার কারো অধিকার নেই। এটা গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে।

আমি জীবিত থাকা অবস্থায় কেউ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হতে পারবে না। রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা সম্পূর্ণ অবৈধ।

এরপর জিয়াউদ্দিন বাবলুর পরিবর্তে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে ফের মহাসচিব ঘোষণা দেন এরশাদ।

এরপর এরশাদেন জীবদ্দশায় ঐ দুটি বলয় এক হয়নি। জাপা নেতৃত্ব নিয়ে ফের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে গত বছরের শেষদিকে।

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য মশিউর রহমান রাঙাকে নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেন এরশাদ।

এরপর ১৭ জানুয়ারি রংপুরে জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এরশাদ। এ ঘটনায় আবারো ক্ষুব্ধ হন রওশনপন্থিরা।

একইসঙ্গে জিএম কাদেরকে সরিয়ে রওশন এরশাদে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে এরশাদকে চাপ প্রয়োগ করেন তারা। সে যাত্রায় সফলতাও আসে।

পরবর্তী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে ২২ মার্চ কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে নিজ স্বাক্ষরিত এক সাংগঠনিক নির্দেশনা জারি করেন এরশাদ।

এরপরই রওশন শিবিরে স্বস্তি ফিরলেও তা বেশিদিন টিকেনি।

অব্যাহতি দেওয়ার মাত্র ১২ দিনের মাথায় চলতি মাসের ৪ এপ্রিল সহোদর জিএম কাদেরকে পুনরায় পার্টির ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন।

জিএম কাদেরকে আবার জাতীয় পার্টির (জাপা) কো-চেয়ারম্যান পুনর্বহাল রেন জাপার চেয়ারম্যান এরশাদ।

তার অবর্তমানে জিএম কাদের পার্টির সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন বলেও ঘোষণা দেন এরশাদ।

এ ঘটনায় রওশন এরশাদ, গত সরকারের দুই মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সাবেক মহাসচিবসহ অনুসায়ীরা ক্ষুব্ধ হন।

সূত্র আরও জানায়- ছোট ভাই জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করায় রওশনপন্থিয় ক্ষুব্ধ হলেও নানা কারণে তারা নিস্ক্রিয় ছিলেন।

অসুস্থতার কারণে এরশাদকে আর কষ্ট না দিতেই নতুন কোনো ঝামেলায় আসেননি রওশন। ঐ সময় জিএম কাদের অনুসারীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েন।

গত ১৪ জুলাই ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন এইচএম এরশাদ।

এরশাদের মৃত্যুর পর গত ১৬ জুলাই জিএম কাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়।

বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা।

তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ০/১-ক ধারা অনুযায়ী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, তার অবর্তমানে জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হবেন।

আজ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জিএম কাদেরই আজ থেকে দলের চেয়ারম্যান হবেন।

সংবাদ সম্মেলনে নতুন চেয়ারম্যান জিএম কাদের এ সময় মহাসচিবের পাশেই ছিলেন।

তবে এরশাদের স্ত্রী ও দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বা তার অনুসারী বলে পরিচিত কাউকে সংবাদ সম্মেলনে এবং আগের বৈঠকে দেখা যায়নি।

এরপর গত ২০ জুলাই দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।

বৈঠকে রওশন এরশাদকে সংসদীয় বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয় বলে সূত্র জানিয়েছে।

তবে এরশাদের শূন্য আসনের প্রার্থিতা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি তারা।

বৈঠক শেষে জিএম কাদের বলেন, রওশন এরশাদ আমাদের অভিভাবক। তার স্নেহ ও পরামর্শে জাতীয় পার্টিকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাবো। তিনি আমাকে আশীর্বাদ করেছেন।

জিএম কাদেরের এমন বক্তব্যে জাতীয় পার্টিতে স্বস্তি মিললেও তা মিলিয়ে যায় দুদিনেই। গতকাল সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে হাতে লেখা বিবৃতি দেন রওশন এরশাদ। বিবৃতিতে শুধু রওশন এরশাদের স্বাক্ষর রয়েছে।

ওই বিবৃতিতে একমত পোষণ করেছেন আরও ৯ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য। বিবৃতিতে বলা হয়, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বেশিরভাগ প্রেসিডিয়াম সদস্যের মতামত না নিয়ে তাকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরবর্তী চেয়ারম্যান নির্বাচিত না করা পর্যন্ত তিনি এ পদে থেকেই দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানান রওশন।

রওশন এরশাদের ওই হাতে লেখা চিঠির সত্যতা এবং এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কাদেরপন্থিরা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায় ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন জিএম কাদেরকে। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্বের প্রশ্নে রওশন এরশাদের বিবৃতিকে উড়ো চিঠি বলে মন্তব্য করেছেন পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

তিনি বলেন, যেহেতু অফিসিয়ালি এ ধরনের কোনো চিঠি আমরা পাইনি, তাই এ বিষয়ে এখনই কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চাচ্ছি না। কোনো প্রতিক্রিয়া থাকলে মিডিয়া ডেকে জানানো হবে। জিএম কাদের বলেছেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই।

জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। নেতৃত্বের প্রশ্নে জাতীয় পার্টিতে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বিবৃতিটি হাতে লেখা ও কাঁচা। এটা বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্য নয়।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাদের পরিবারে পিতৃতুল্য ছিলেন, সেভাবেই বেগম রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মতো।

উল্লেখ্য, সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তিসহ রাষ্ট্রের সব ধরনের ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায় জাতীয় পার্টি। বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখলের পর ৮০’র দশকে দলটি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সদ্য প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

প্রতিষ্ঠালগ্নে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দলে ভাঙন ধরান এরশাদ। মন্ত্রিসভার সদস্য করাসহ নানা প্রভোলনে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাগিয়ে নেন তিনি।

তবে নিজ জাতীয় পার্টিরও ভাঙন ঠেকাতে পারেননি এরশাদ।

আপনি আরও পড়তে পারেন