ডিএনডির খাল যেন মৃত্যুফাঁদ

রাজধানীর খালগুলো যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ। প্রতিবছরই রাজধানীর বিভিন্ন খালে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও যেন রূপ নিয়েছে ধারাবাহিকতায়। তবুও খালের অভিভাবক সরকারি দপ্তরগুলো গ্রহণ করছে না কোনো উদ্যোগ।

ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর এসব খাল পরিষ্কার করে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টাও দেখা যায় না। যে কারণে বাড়ছে শিশুমৃত্যু।

সর্বশেষ গত শনিবার রাজধানীর কদমতলী এলাকায় পাঁচ বছরের শিশু আশামনিও (তোহা) প্রাণ হারিয়েছে ডিএনডির খালে।

ওই খালে ডুবে যাওয়ার পাঁচদিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আশামনির লাশ খুঁজে পায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা।

জানা গেছে, বল কুড়াতে গিয়ে কদমতলীর মেরাজ নগরের ডিএনডি খালে তলিয়ে যায় শিশু আশামনি। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা সেদিন থেকেই খালে নেমে তল্লাশি চালালেও গত পাঁচদিন ধরে সফল হননি তারা।

আশামনির চাচা বিল্লাল হোসেন লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আশামনির বাবা-মা তাদের সন্তানের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন।

তবে অন্তত লাশ বুকে জড়িয়ে ধরার আকুতি জানাতে আঁচল পেতেছিলেন আশামনির মা তানিয়া।সবশেষে তার কোলে সন্তান ফিরে এলো ঠিকই, তবে লাশ হয়ে।

সন্তানকে না পেয়ে গতকাল সকালে আশামনির মা আকুতি জানিয়েছিলেন, আমাদের আশামনিকে কি শেষ দেখা দেখতে পাবো না? আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দ্রুত আমাদের আশামনিকে উদ্ধার চাই। বাবা এরশাদ বলেছিলেন, কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকাইয়া গেছে।

আমাদের মেয়ে যে আর বেঁচে নেই তা আমরা জানি। এখন শুধু একটিই চাওয়া— যক্ষের ধনের লাশটা একবার হলেও দেখতে চাই। অন্তত আমার মেয়ের লাশটা খুঁজে দেন আপনারা।

গতকাল সকালে নিখোঁজ আশামনির সন্ধানে ডিএনডি খাল-সংলগ্ন মেরাজ নগর ফারুকের গ্যারেজে দোয়া মুনাজাতও অনুষ্ঠিত হয়।

মেরাজ নগর বায়তুস সালাহ জামে মসজিদ, মরহুম হাজি আব্দুল লতিফ জামে মসজিদসহ এলাকার বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও এইচ ইউসুফ হাইস্কুলের শিক্ষার্থীসহ এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন এ মুনাজাতে উপস্থিত ছিলেন।মুনাজাতের পরই দুপুরের দিকে আশামনির লাশ খুঁজে পায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা।

শনিবার বিকাল পৌনে ৪টায় আশামনি মেরাজ নগর ডি-ব্লক বাসাসংলগ্ন খালি জায়গায় তার বন্ধু ফরাজ (৬), আব্দুল্যাহ (৫), রাহিমের (৫) সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিল।

এসময় পাশে ডিএনডির খালে বল পড়ে যায়। আশামনি বলটি উঠাতে গিয়ে খালের পানিতে ডুবে যায়।

এসময় আশামনি আমাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দেয়। শিশু ফরাজ আশামনিকে উদ্ধার করতে আশামনিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। এসময় ফরাজের পাও পিছলে যায়।

এরই মধ্যে আশামনি ডুবে যায় ও স্রোতে অন্যত্রে চলে যায়। শিশু আব্দুল্যাহ তার মায়ের কাছে সংবাদ জানায়। শিশুর মা আসতে আসতে আশামনি নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন খালে নেমেও শিশু আশামনির সন্ধান পায়নি।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন বলেন, খালে জমা আবর্জনা অনেকটা পরিষ্কার করতে হয়েছে গত চারদিনে।

এরই মধ্যে আমাদের ডুবুরিরা সেখানে তল্লাশি চালিয়েছেন। গতকাল দুপুরে তাদের একজনের পায়ে মৃতদেহটি আটকায়।

ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক নজমুজ্জামান জানান, ঘটনার দিন থেকেই তাদের দুটি ইউনিট ওই খাল থেকে শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টায় তল্লাশি চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড নোংরা পানিতে জমে থাকা আবর্জনার কারণে কাজে সমস্যা হচ্ছিল।

পুরো খাল ময়লায় পূর্ণ। মাঝে মাঝে ময়লার স্তর এমন হয়ে রয়েছে যে মনে হবে নিচে পানি নেই। কিন্তু কেউ পা দিলে তলিয়ে যাবে। শিশুটিও ওইভাবে তলিয়ে যায়। ময়লার কারণেই তাকে খুঁজে পেতে এত সময় লাগলো। এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল।

আশামনিকে খুঁজে বের করার জন্য তল্লাশি আরও জোরদার করার দাবিতে গত মঙ্গলবার মানববন্ধন করেন স্থানীয় বাসিন্দারাও।

সেনা সদস্যরাও সেদিন তল্লাশি অভিযানে যোগ দেন। স্থানীয় কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক শ্রমিক দিয়ে ময়লা সরানোর ব্যবস্থা করেন।

স্থানীয়রা জানান, ওই এলাকাটি বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। আগে ছিলো শ্যামপুর ইউনিয়ন, তাই অবহেলিত ছিলো। বর্তমানে ডিএনডি খাল সংস্কারের কাজ চলছে।

এদিকে আশামনি নিখোঁজের পরদিন রোববার কদমতলী এলাকায় খালে পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু আসাদুল (৫)। পরদিন সোমবার সকালে খালে তল্লাশি চালিয়ে আসাদুলের লাশ উদ্ধার করা হয়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের কর্মকর্তা এরশাদ হোসেন জানান, রোববার বিকাল ৪টার দিকে খালে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হয় আসাদুল।

খবর পেয়ে তিনজন ডুবুরি ঘটনাস্থলে মধ্যরাত পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়েও শিশুটিকে খুঁজে পায়নি। পরদিন সকালে আবারো তল্লাশি শুরু করে সকাল ৯টার দিকে শিশু আসাদুলের লাশ পাওয়া যায়।

এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন খাল, খোলা নর্দমা, অরক্ষিত নলকূপ, স্যুয়ারেজ লাইন, ডোবা-নালা নগর শিশুদের জন্য মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরই শিশুরা সামান্য অসাবধানতায় মর্মান্তিকভাবে জীবন হারাচ্ছে।

তবুও মৃত্যুফাঁদগুলো কোনোভাবেই বিপদমুক্ত করার উদ্যোগ নেয় না কেউ। নানা অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা, অসচেতনতায় শিশুদের জন্য রাজধানী ঢাকা ক্রমেই অনিরাপদ বাসস্থানে পরিণত হতে চলেছে।

মহল্লার অলিগলি পর্যায়েও ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, খোলা ড্রেন, গভীর-অগভীর খানাখন্দ, গর্ত, নিরাপত্তা বেষ্টনীবিহীন নির্মাণ কর্মকাণ্ড, নর্দমা-খালগুলো শিশুদের জন্য তো বটেই, বড়দের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস ও দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতায় থাকা এসব মৃত্যুফাঁদ ওতপেতে আছে রাজধানীর রাস্তাঘাট, অলিগলির কোণে কোণে।

২০১২ সালেও রাজধানীর বাড্ডার একটি খালে ডুবে শাহরিয়ার রুদ্র নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালে যাত্রাবাড়ীর কাজলারপাড় মধ্যপাড়ায় খালে ডুবে তামিম (৪) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।

২০১৭ সালে যাত্রাবাড়ী ভাঙ্গাপ্রেস এলাকায় ওয়াসার খালের পানিতে ডুবে মারা যায় কামরুল ইসলাম বাবু (১৪) নামের আরেক কিশোর। ২০১৯ সালে ডেমরায় খালে ডুবে মৃত্যু হয় আসিফ হাসান প্রান্ত নামের আরেক স্কুলছাত্রের।

এছাড়াও শাহজাহানপুরে অরক্ষিত নলকূপের পাইপে পড়ে শিশু জিহাদের মর্মান্তিক মৃত্যু তৎকালীন সময়ে গোটা দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছিল। শ্যামপুরে নর্দমার বিষজলে শিশু নীরবের প্রাণহানিতেও শেষ হয়নি মৃত্যুর এমন মিছিল।

মহাখালী তালতলার নালায় পড়েও করুণ মৃত্যু ঘটেছিল ছয় বছরের শিশু সানজিদার। নালার পাড়ে খেলতে গিয়ে সানজিদা পানিতে পড়ে যায়। দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টার উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন