কালীগঞ্জে পুষ্টিকর ঔষধীগুণে ভরা ব্রকলি চাষে রণজিৎ এখন স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী

রিয়াজ উদ্দীন (ঝিনাইদহ) জেলা প্রতিনিধিঃ পরের ক্ষেতে কাজ করতেন এই তো -কয় বছর আগে। সে সময় তার রোজগারের টাকায় পরিবারের সদস্যদের একদিকের চাহিদা মেটাতে পারলেও অন্যদিক থাকতো অপূরনীয়। সংসারে পিছু ছাড়তো না। তাই বলে হতাশাকে কাছে ভিড়তে দেননি তিনি। দিনরাত কৃষিতে হাড় ভাঙা পরিশ্রম আর সাধনায় করে এখন সেদিন পাল্টে ফেলেছেন। কেননা কামলা খাটা রনজিতের ক্ষেতেই এখন প্রতিদিন ৭/৮ জন কামলা কাজ করছেন। কৃষিক্ষেতে পরিশ্রমের মাধ্যমে মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে তিনি হয়েছেন উপজেলার মধ্যে একজন স্বনির্ভর কৃষক। এ বছর অন্যান্য সবজির সাথে তিনি প্রায় ২৪ শতক জমিতে সবুজ ফুলকপির ন্যায় দেখতে (ব্রকলি) আর লাল পাতা কপি (পার্পল) আবার কেউ বলেন (রেড প্রিণ্ট) যা চাষ করে এলাকায় বেশ আলোচনায় এসেছেন। সরেজমিনে কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের গোপিনাথপুর গ্রামের মাঠে গেলে দেখা যায়, দিগন্ত জোড়া মাঠটিতে নানা ধরনের শীতকালীন সবজির চাষ করেছেন। কিন্ত এ গ্রামের মাঠের মধ্যে কৃষক রনজিতের ক্ষেতে চাষ করা হয়েছে ব্যতিক্রমী সবজির। তার ক্ষেতে গেলে দেখা যায় ব্রকলি আর অন্যপাশে লালচে রঙের পাতা কপি (রেড প্রিণ্ট) চাষ করেছেন। সমগ্র ক্ষেতটি লাল আর সবুজে এক অপরুপ ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক রনজিত কুমার বিশ্বাস জানান, তার বাবা কাকারাও সবজির চাষ করতেন। কিন্ত তিনি নিজে বাবার দেয়া মাত্র ১৮ শতক জমি পেয়েছেন। এতটুকু জমিতে চাষ করে খরচবাদে সংসারের সদ্যস্যদের ২ মাসের খাবারও আসতো না। তাই পরের ক্ষেতে কামলার কাজ করতেন। তবে তার বিশ্বাস ছিল পরিশ্রম করলে তিনিও এলাকার অন্য কৃষকদের মত একদিন সফল হতে পারবেন। এ বিশ্বাস থেকেই সংসারে একটিমাত্র গরু ছিল তা বিক্রি করে ১৯৯৯ সালে ২ বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে গাঁদা ফুলের চাষ করেন। প্রথম চেষ্টাতেই তিনি সফল হন। কেননা ওই বছর ফুলের দাম ছিল খানিকটা অবিশ্বাস্য আকাশ ছোয়া। তিনি দুই বিঘা জমির ফুল বিক্রির মাধ্যমে যাবতীয় খরচ বাদে প্রায় ১২ লাখ টাকা আয় করেন। এরপর থেকে শুরু তার সবজি চাষ। ফুল ও সবজি চাষ করে বর্তমানে তিনি ২২ বিঘা জমিতে চাষ করছেন। এরমধ্যে যশোর থেকে বীজ এনে মোট ২৪ শতক জমিতে ব্রকলি ও লাল রঙের পাতাকপি (রেড প্রিন্টের) চাষ করেছেন। মানবদেহের জন্য এ দুই ধরনের সবজি কালীগঞ্জের জন্য প্রথম। তবে তার ইউনিয়নের চাঁদবা গ্রামের সৌখিন চাষী মিজানুর রহমানও একখন্ড জমিতে ব্রকলির চাষ করেছেন বলে শুনেছেন। এলাকায় প্রথম চাষ তাই এ সবজি কিভাবে খেতে হয় তা এ এলাকার মানুষ জানে না। তিনি বলেন, কালীগঞ্জ শহরের একদিন কিছু ব্রকলি নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্ত খুব কম দামে তাকে বিক্রি করতে হয়েছে। এরপর হাটে আসা কাঁচামাল ব্যাবসায়ীদের নিকট থেকে জানতে পারেন ঢাকাতে এর খুব চাহিদা। ব্রকলি ঢাকার বাজারে খুব চাহিদা। শুধু সবজি হিসেবে নয় সকল চাইনিজ হোটেল ও বড় বড় রেস্তোরায় খাবারের সাথে সালাদ হিসেবে পরিবেশন করা হয়। তিনি এ পর্যন্ত ব্রকলি ৩ চালান ঢাকায় পাঠিয়ে মোট ৭২ হাজার টাকা পেয়েছেন। ক্ষেতে এখনও যা আছে তা থেকে আরও বেশ কিছু টাকা আসবে। কম খরচে বেশি লাভ তাই আগামীতে তিনি ব্রকলি ৫ বিঘা চাষ করবেন বলে আশা করছেন। ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান জানান, গোপিনাথপুর গ্রামের কৃষক রনজিত বিশ্বাস ও চাঁদবা গ্রামের মিজানুর রহমান এ এলাকাতে প্রথম ব্রকলি ও রেড প্রিন্টের চাষ করেছেন। প্রতিনিয়ত তিনি খোঁজ খবর নিচ্ছেন। রনজিত ইতোমধ্যে রনজিত বিশ্বাস ঢাকায় নিয়ে ব্রকলি বিক্রি করে বেশ পয়সা পেয়েছেন। তবে কৃষক মিজানুর রহমান এখনও বিক্রি শুরু করেননি। উভয় কৃষকেরই যাবতীয় খরচ বাদে ভালো পয়সা আসবে। তিনি বলেন, কৃষক রনজিত বিশ্বাস ও মিজানুর রহমান দুজনই গুণী কৃষক। এদের মধ্যে রনজিত এক সময়ে পরের ক্ষেতে কামলার কাজ করতেন কিন্ত কৃষিতে উন্নতি করার কারনে তার ক্ষেতে প্রতিদিন ৫/৭ জন কৃষি শ্রমিক করে থাকে। আর কৃষক মিজানুর রহমান একজন সৌখিন চাষী। চাকুরীর পাশাপাশি তিনি নানা ধরনের সবজি ও ফলের চাষ করে থাকেন। তারা দুজনেই আদর্শ কৃষক বললে ভুল হবে না। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের ২ পরিশ্রমী কৃষক রনজিত বিশ্বাস ও মিজানুর রহমান এ এলাকায় প্রথম অত্যন্ত সু-স্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি ব্রকলীর চাষ করেছেন। তিনি বলেন শুধু সবজি নয় সালাদ হিসেবেও ব্রকলির চাহিদা রয়েছে। এ সবজিতে রয়েছে রোগ প্রতিরোধের উচ্চমাত্রার ক্ষমতা। এক ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে কাজ করে। রক্তে কলেষ্ট্রল কমাতে সাহায্য করে। ওজন কমাতে ম্যাজিকের মত কাজ করে। এছাড়াও ব্রকলিতে রয়েছে নানা ধরনের ভিটামিন যা শরীরের সুস্থতার জন্য খুব প্রয়োজন। এ উপজেলায় ব্রকলির চাষ ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। তবে অসংখ্য কৃষক ব্রকলি সম্পর্কে তাদের কাছে খোঁজ নিচ্ছেন। ফলে ধরেই নেয়া যায় আগামী ব্রকলির চাষ বৃদ্ধি পাবে। লাভজনক ও শরীরের জন্য উপকারী তাই ব্রকলি চাষে কৃষকদেরকে তারা উৎসাহিত করছেন বলে যোগ করেন এই কৃষিবিদ।

আপনি আরও পড়তে পারেন