মানুষটা আমার বড্ড প্রিয়

মানুষটা আমার বড্ড প্রিয়

‘আমার খুব খারাপ লাগছে। কথাটা বলা কষ্টের, তবুও বলি। উনাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের একটি স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছিল। যাতে তিনি কম কষ্ট ভোগ করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষটা আমার বড্ড প্রিয়।’

শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে আবেগতাড়িত কণ্ঠে কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন আলী যাকেরের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর।

বরেণ্য অভিনেতা, নির্দেশক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের স্মৃতিচারণা করে আসাদুজ্জামান নূর কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে বলেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে আমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত। অনেকদিন এক সঙ্গে কাজ করেছি। কতশত স্মৃতি আমাদের।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আলী যাকেরকে যখন ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, তখন কিন্তু উনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না। এরপর করোনার নমুনা পরীক্ষা করালে ফল আসে, ‘পজিটিভ’। বিষয়টি এতটা কষ্টদায়ক যে, এই ব্যাপারে কথা বলতেও খারাপ লাগছে।

প্রসঙ্গত, ক্যান্সারে আক্রান্ত অভিনেতা আলী যাকের করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সপ্তাহ দুই আগে। রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে গত রোববার বাসায়ও ফিরে গিয়েছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শুক্রবার ভোরে সেখানেই মারা যান তিনি।তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

গত শতকের সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে মঞ্চ আর টেলিভিশনে দাপুটে অভিনয়ের জন্য দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন নিয়ে আছেন আলী যাকের। তার স্ত্রী সারা যাকেরও মঞ্চ আর টেলিভিশনের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৭ সালে। তাদের দুই ছেলেমেয়ে ইরেশ যাকের ও শ্রেয়া সর্বজয়াও অভিনয়শিল্পী।

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই নাট্যজনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । তার মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারালো।

আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলী যাকেরের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আলী যাকেরের মরদেহ শুক্রবার বেলা ১১টায় নিয়ে যাওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে। একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিককে সেখানে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বনানী কবরস্থানে। সেখানে বাদ আসর কবরস্থান মসজিদে জানাজার পর তাকে দাফন করা হবে।

১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মোহাম্মদ তাহের ও তার স্ত্রী রিজিয়া তাহেরের ঘরে আলী যাকের যখন জন্ম নিলেন, চারপাশে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। চট্টগ্রামে জন্ম হলেও আলী যাকেরের পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। বাবা মোহাম্মদ তাহেরের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের চাকরির সুবাদে ছেলেবেলায় এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলী যাকের। ফেনী, খুলনা, কুষ্টিয়া ঘুরে বাবা যখন প্রাদেশিক সরকারের সচিব হলেন, তখন আলী যাকেরের পরিবার থিতু হয় ঢাকায়।

সেন্ট গ্রেগরি থেকে ম্যাট্রিক এবং নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে আলী যাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই জড়িয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়, সেই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিতে। আলী যাকের তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেলে তিনি মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে করাচিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডব্লিউ এস ক্রফোর্ডাসে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে আলী যাকেরের কর্মজীবন শুরু করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এশিয়াটিকের দায়িত্ব নেন, মৃত্যুর সময় তিনি কোম্পানির গ্রুপ চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলী যাকের প্রথমে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবির তাকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রচারযুদ্ধে অংশ নিতে। আলী যাকের যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।

যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফেরার পর ব্যস্ত হন এশিয়াটিককে দাঁড় করানোর কাজে। অভিনেতা, নির্দেশক মামুনুর রশীদের সঙ্গে তখন তার দারুণ বন্ধুত্ব। সেই সূত্র ধরেই ১৯৭২ সালে আরণ্যকের ‘কবর’ নাটকে অভিনয় করেন আলী যাকের, শুরু হয় মঞ্চে তার পথচলার। সে নাটক দেখে পরে জিয়া হায়দার ও আতাউর রহমান তাকে নিয়ে যান তাদের দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। মৃত্যু পর্যন্ত আলী যাকের এই নাট্যদলের সভাপতি ছিলেন।

মঞ্চে নূরলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজীর চরিত্রে আলী যাকেরের অভিনয় এখনও দর্শক মনে রেখেছে। ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি পাথর’, ‘আজ রবিবার’এর টিভি নাটকে অভিনয় করেও তিনি প্রশংসা পেয়েছেন। ‘অচলায়তন’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’সহ বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন আলী যাকের। বেতারে অর্ধশতাধিক শ্রুতি নাটকেও কাজ করেছেন।

অভিনয়, নির্দেশনার বাইরে তিনি ছিলেন একজন নাট্যসংগঠক; পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সঙ্গে। নাটকে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া দীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন আলী যাকের। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আলী যাকের যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটিরও সদস্য ছিলেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন