জীবন বাজি রেখে দেশটা গড়ে দিলেন অথচ নিজের ঘরটাই গড়তে পারলেন না মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ

জীবন বাজি রেখে দেশটা গড়ে দিলেন অথচ নিজের ঘরটাই গড়তে পারলেন না মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ


পরিবারের মানবেতর জীবনযাপন ঃ পাননি বয়স্ক ভাতা

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ

“ জীবন বাজি রাইখ্যা দেশের লাইগ্যা, দেশের মানুষের লাইগ্যা নয়ডা মাস আমার স্বামী যুদ্ধ করল, অথচ এখন কেউ আমাদের কোনো খবরও নেয় না। দেশের মানুষের জন্য দেশটা গড়ে দিলেও নিজের জন্য একটা ঘর বানাইতে পারল না। এখন মানুষের বাড়িতেই থাহি। আমরা বাঁচার জন্য প্রতিদিনই যুদ্ধ করছিগো বাজান। দেশতো অনেক উন্নয়ণ হচ্ছে।

আমার একটা ঘর হইবো নাগো বাজান। আমাগো দেহার কেউ নেই।” এমনি করে আক্ষেপ করে মনের দুঃখে কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের স্ত্রী সোলামে খাতুন। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন সোলামে খাতুনের স্বামী আব্দুল আজিজ মিয়া। নয়মাস প্রাণপণ যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনেন।

কিন্তু নিজের কিংবা পরিবারের ভাগ্যের বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারেনি। অবশেষে চলতি বছরের পহেলা জুন জীবন যুদ্ধে হেরে গেলেন রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের ভায়েলা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ মিয়া। দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে যেতে পারেননি জীবনের পড়ন্ত বেলায়।

মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মিয়ার স্ত্রী সোলেমা খাতুন এখন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্বামী মারা যাওয়ার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কপালে জোটেনি স্বামীর ভাতা। নিজেও পান না বয়স্কভাতা। দপ্তরে-দপ্তরে ধরণা দিয়েও মিলছে না ইতিবাচক সাড়া।

পরিবারটি থাকার জন্য কোন জায়গা নেই। নেই কোনো জমিজমা অথবা ঘর বাড়ি। বর্তমানে তারা অন্যের থাকতে দেয়া একটি মাটির ঘরে কোন রকমে বসবাস করছেন। সম্প্রতি বিগত বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এ সকল তথ্য জানা যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে আব্দুল আজিজের পরিবার। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের পরিবার সূত্রে জানা যায়, দরিদ্র পরিবারের জন্য সন্তান আজিজ মিয়া। ২০ বছরের টগবগে যুবক আজিজ দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

তিনি রূপগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীন হয় দেশ। শুরু হয় দেশের উন্নয়ন। কিন্তু দেশের উন্নয়ন ঘটলেও ঘটেনি আজিজ মিয়ার ভাগ্যের উন্নয়ন। তেমন কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় রংয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন।

পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন ভুলতা এলাকার সোলেমা বেগমকে। তাদের দুজনের সংসারে চার ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়। অভাবের সংসারে ৬ সন্তানকে লেখাপড়াও করাতে পারেনি। রংয়ের কাজ করে তার স্বল্প আয় শেষ হয়ে যেত সংসার চালাতেই।

সংসারের ঘানি টানতে টানতে নিজে কিনতে পারেনি এক টুকরো জমি ও নির্মাণ করতে পারে বাড়িঘরও। তাই এ কারণে বাধ্য হয়ে পাশর্^বর্তী এক ব্যক্তির থাকতে দেওয়া ছোট একটি মাটির ঘরেই চার ছেলে ও দুই সন্তান বসবাস করতে হতো তাকে।

আজিজ মিয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া সরকারিভাবে আর কোন সুযোগ সুবিধা পাননি। বার্ধক্যজনিত কারণে চলতি বছরের ১ লা জুন আজিজ মিয়ার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে আজিজ কাউকে নমিনি না দিয়ে যাওয়ায় গত ৭ মাস ধরে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে তাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে না।


আব্দুল আজিজ মিয়ার মারা যাওয়ার ১৫ দিনে মধ্যেই তার স্ত্রী সোলেমা বেগম ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সকল কাগজপত্র সমাজসেবা অফিসে জমা দিলেও কোন কাজ হয়নি। সমাজসেবা অফিস থেকে তাদের বলা হয়েছে কাগজপত্র হেড অফিসে প্রসেসিং হতে দীর্ঘ সময় লাগবে হলে আমরাই আপনাদের জানাবো।

কিন্তু ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও সমাজসেবা অফিস থেকে কিছু জানানো হয়নি তাদের। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সরকারিভাবে একটি ঘরে জন্য জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও কোন সুফল পাননি বলে অভিযোগ করেন মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মিয়ার পরিবার।

আব্দুল আজিজ মিয়ার বড় ছেলে সোলেমান মিয়া জানান, তারা চার ভাই বিয়ে করেছেন। তারা চার ভাই দিন মজুরি ও রিক্সা চালিয়ে নিজেদের সংসার চালাতেই তাদের কষ্ট হয়। তাদের দুই বোনকে বিয়ে দিলেও স্বামীর ঘরে সুখ মেলেনি তাদের।

মা ও দুইবোনের সংসারও চালাতে হচ্ছে তাদেরকেই। অভাবের সংসারে তাদের নুন আনতে পানথা ফুরানো মতো অবস্থা। পাশর্^বর্তী এক ব্যাক্তির থাকতে দেওয়ার ছোট্ট একটি মাটির পরিবার পরিজন নিয়ে কোন রকমে বসবাস করছেন তারা।

বাবা আজিজ মিয়া বেঁচে থাকাকালীন মাসে উপজেলা থেকে যে ভাতা পেত তা দিয়ে সংসার একটু সচ্ছল হত। বাবা মারা যাওয়ার পর কাগজপত্র জটিলতায় এ সময় মারা যাওয়ার পর সে ভাতাও বন্ধ হয়ে গেছে। ভাতার টাকা না পাওয়া বেশ বিপাকেই পড়তে হচ্ছে তাদেরকে।

আজিজ মিয়ার স্ত্রী সোলেমা বেগম জানান, বাজানরে আমার জামাই দেশের লইগা যুদ্ধ করছে। কিন্তু ভাতার টাকা ছাড়া সরকার আমাগো কিছুই দেয় নাই। আমার জামাই মরার পর থেইকা হেই ভাতাও পাই না।

এখন ভাতার জন্য, বাঁচার জন্য প্রতিদিন আমরা যুদ্ধ করছি। পোলাপান লইয়া সংসার চালাইতে খুব কষ্ট অইতাছে। হুনছি সরকার গরীবগোরে সরকারি ঘর দিতাছে দেয় কিন্তু কয়ডা বছর দইরা চেয়ারম্যান ও উপজেলার স্যার ম্যাডাম গো কাছে ঘুইরাও একটি ঘর পাইলাম না। আমরা অহন মাইনষের দেওয়া ঘরে পোলাপাইন লইয়া কোন রহম থাকতাছি। আমার জামাইর ভাতা ও একটা সরকার যাতে কইরা আমারে একটা থাকনের ঘর দেয় এইডাই আমার দাবি।


উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, মৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের পরিবার আবেদন করে থাকলে খুব শীঘ্রই তাদের নতুন করে ভাতা বই দিয়ে ভাতা প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ্ নূসরাত জাহান বলেন, গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজেরর বাড়িঘর নেই এ বিষয়টি প্রশাসনের জানা ছিল না। শীঘ্রই সরকারিভাবে আব্দুল আজিজের পরিবারের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আব্দুল আজিজের পরিবার যাতে ভাতা পান সে ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিব।


রূপগঞ্জ প্রতিনিধি।

আপনি আরও পড়তে পারেন