বিখ্যাত পপ তারকা থেকে যেভাবে হলেন ইসলামি বক্তা

বিখ্যাত পপ তারকা থেকে যেভাবে হলেন ইসলামি বক্তা

জুনায়েদ জামশেদ। এমন এক ব্যক্তিত্ব যার নাম নিলে শ্রদ্ধায় মাথানত হয় অনেকেরই। জুনায়েদ জামশেদের জীবন অতিবাহিত হয়েছে দু’ধারায়। প্রথম ধারায় পাকিস্তানি নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় ও অন্যতম পপ তারকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন জুনায়েদ। 

‘দিল দিল পাকিস্তান’, ‘তুম মিল গায়ি’, ‘সাওয়ালি সালোনি’ কিংবা ‘উহ কৌন থি’ গানগুলো নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানিদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘ভাইটাল সাইন’স নামক ওই সময়ের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড দলের গান গেয়ে জামশেদ নিজেকে জনপ্রিয় পপ তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। 

এরপরের ধারায় তিনি নিজেকে জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা ও ইসলামি সংগীতশিল্পীতে পরিণত করেন। দ্য মুসলিম ৫০০ নামের একটি ওয়েবসাইট তাকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

জুনায়েদ জামশেদের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। বাবা জামশেদ আকবর খান ও মা নাফিসা আকবরের তিন ছেলে এক মেয়ের মাঝে তিনি ছিলেন প্রথম। জুনায়েদ লাহোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করেন। এরপর শখের বশেই রাহেল হায়াত ও শাহজাদ হাসানের সঙ্গে ১৯৮৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশাত্মবোধক গান ‘দিল দিল পাকিস্তান’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দেশটির প্রথম পপ ব্যান্ড ‘ভাইটাল সাইন’। 

তাদের প্রথম হিট এ্যালবাম ‘দিল দিল পাকিস্তান’ এনে দেয় আকাশচুম্বী খ্যাতি। এই গানটিই ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়। পরিণত করে একজন শৌখিন সংগীতশিল্পী থেকে পেশাদার শিল্পীতে। বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে জুনায়েদ একজন পেশাদার প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলেন। সংগীতটা আরম্ভ করেছিলেন অনেকটা শখের বশেই। কিন্তু এই প্রাথমিক সফলতার ফলে রাহেল ও সাজ্জাদ তাকে প্রেরণা জোগান। বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় অ্যালবাম বের হওয়ার পর ১৯৯৫ সালে যখন ব্যান্ড ভেঙে যায়, জুনায়েদ জামশেদ তখন একক ক্যারিয়ার গড়তে আরম্ভ করেন। এতেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। 

পাকিস্তানের প্রথম পপস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে। তবে পপ গানের শিল্পী হিসেবেই তাকে এক সময় পাকিস্তানিরা চিনলেও তিনি কখনও সংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে চাননি। গান গাওয়ার সময়েই তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের পাইলট হতে চেয়েছিলেন। চোখের দৃষ্টিজনিত সমস্যার কারণে তার এ স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বিমানবাহিনীতে অল্প কিছুদিন বেসামরিক ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গীত ‘কসম উস ওয়াক্ত কি’, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সংগীত ‘পালাটনা ঝাপাটনা’তে শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত করে তাকেই। জনপ্রিয়তায় যখন তুঙ্গে এবং একের পর এক হিট অ্যালবাম বের হচ্ছে, তখনই হঠাৎ সংগীত ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। ২০০২ সালে সংবাদ সম্মেলন করে জানান এই খবর। তখন সংগীতাঙ্গনে নেমে আসে শিল্পীবিয়োগে তুমুল ঝড়। অসংখ্য ভক্ত তাদের প্রিয়শিল্পীকে হারানোর খবরে হয়ে পড়ে বেদনাহত। শেষমেশ ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সংগীতজগৎকে বিদায় জানান তিনি। 

আসলে বিদায় জানানো বলা ঠিক হবে না, মেধাবী এই শিল্পী তার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করে খ্যাতি ও ভবিষ্যতের বদলে ইসলামকে মনে প্রানে বেছে নেন। ৫২ বছরের দীর্ঘ জীবনের শেষ দিকে তিনি ধর্ম প্রচার করেছেন, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ধর্মীয় বিকাশ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ২০১৬ সালে ধর্ম অবমাননার জন্য ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছিলেন জামশেদ।

যে ‘দিল দিল পাকিস্তান’, ‘এইতেবার’, ‘উস রাহ পার’, ‘দিল কি বাত’ এর মতো হিট অ্যালবামের শিল্পী তিনিই পরে গেয়েছেন- ‘বদরুদ্দোজা শামসুদ্দোহা’, ‘মেহবুবে ইয়াজদান’, ‘জালওয়ায়ে জানান’ এর মতো উচ্চাঙ্গের নাশিদ ইসলামি সংগীত। তার মধুর কণ্ঠে গাওয়া ‘অ্যায় আল্লাহ তুহি আতা তো যুদো সাখা’ সত্যিই চমৎকার।  

জুনায়েদ উর্দু গজল, হামদ-নাতের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের মনের স্থান লাভ করে আছেন। তিনি সংগীতচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত তাবলিগের কাজ করতেন। সংগীত পরিবেশন ও বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেওয়ার জন্য তিনি অনেকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। সমাজসেবার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার সঙ্গে।  

তবে ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর চিত্রল থেকে ইসলামাবাদ ফেরার পথে বিমান দুর্ঘটনায় স্ত্রীসহ জুনায়েদের মৃত্যু হয়। তার জানাজায় হাজির হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। মানুষের হৃদয়ের শ্রদ্ধার মণিকোঠায় এখনও তিনি জায়গা করে আছেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন