ঈদে গাদাগাদি এড়াতে বাস চালুর প্রস্তাব

ঈদে গাদাগাদি এড়াতে বাস চালুর প্রস্তাব

করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সারা দেশে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন চলাচল। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় কোরবানির ঈদের আগে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া বা শিথিল করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এ অবস্থায় ঈদে ঘরমুখো মানুষদের বাড়ি যেতে সুবিধা হবে- এমন বিবেচনায় বিধিনিষেধের মধ্যেই গণপরিবহন চালুর দাবি জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের এখন একটাই চাওয়া, ঈদের আগে চালু হোক দূরপাল্লার বাস চলাচল। তারা বলছেন, সড়ক পরিবহন খাতের ৫০ লাখ শ্রমিক এই মুহূর্তে বেকার। এ অবস্থায় তাদের জীবিকা নির্বাহ এবং সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের বাড়ি যাওয়ার ভোগান্তি কমাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরপাল্লার বাস চালুর অনুমতি দেওয়া হোক।

সড়ক পরিবহন খাতের নেতারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু করা, বিশেষ করে দূরপাল্লার বাস চালুর বিষয়ে ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রস্তাব দিয়েছেন।

এদিকে তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পুলিশের শীর্ষ ব্যক্তিরা গত ২৪ জুন অনুষ্ঠিত এক সভায় মোট ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে জুনের ওই সময় করোনা সংক্রমণের যে পরিস্থিতি ছিল এখন পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। ওই সময়ে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা যেখানে ৫ হাজারের আশপাশে ছিল, এখন তা সাড়ে ১১ হাজার ছাড়িয়েছে।

ঈদুল ফিতরে মানুষের বাড়ি ফেরা ঠেকাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কিছুই কার্যকর হয়নি। বরং যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবে বাড়ি ফিরেছিলেন ওই ঈদে। ঈদের পর থেকেই দেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হতে শুরু করে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পরিবহন শ্রমিক আছেন ৭০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ জরুরি পণ্য পরিবহনের কাজে জ[ড়িত আছেন। বাকি ৫০ লাখ শ্রমিক বেকার রয়েছেন।

আমরা তাই সরকারের কাছে আগে থেকেই দাবি জানাচ্ছি- স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্তত দূরপাল্লার পরিবহন চালানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য। কারণ ঈদুল আজহায় মানুষ বাড়ি যাবে বিকল্প বাহনে। ট্রাকে, পিকআপে, মোটর সাইকেলে, জরুরি সেবা ব্যানার লাগিয়ে মাইক্রোবাসে বেশি অর্থ খরচ করে মানুষ বাড়ি ফিরবে। তার চেয়ে দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাস স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালানোর ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার।

ওসমান আলী বলেন, সরকারের কাছে আমরা পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে ওএমএস-এর চাল, টিসিবির তেল সরবরাহের প্রস্তাব করেছি। এছাড়া অন্যান্য শ্রমিকদের মতো সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয়ে এসব বিষয় বার বার তুলে ধরা হয়েছে বলে ওসমান আলী জানান।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের সহায়তা করা হচ্ছে। এছাড়া ঈদুল আজহা সামনে রেখে তাদের চাল, চিনি, সেমাই ও গরুর মাংস দেওয়া হবে। ঈদুল আজহার আগে ১৬ জুলাই থেকে এই সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি।

করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী দেশজুড়ে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন চলাচল। ওসমান আলীর মতো অন্যান্য পরিবহন নেতারাও একই সুরে বলছেন, গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাড়তি অর্থ খরচ করে অন্যান্য যানবাহনে যাতায়াত করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অন্যদিকে দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ থাকায় প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে গণপরিবহনের মালিক, চালকসহ সংশ্লিষ্টদের।

ওসমান আলী বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করায় প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের বেঁচে থাকার মতো অবলম্বন নেই। গাড়ি চললে পরিবহন শ্রমিকদের সংসার চলে। উপার্জনের পথ বন্ধ থাকায় পরিবহন শ্রমিকরা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার যন্ত্রণা পরিবহন শ্রমিকদের কাছে করোনা সংক্রমণের ভয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন শ্রমিকদের সবসময় গণমানুষের সংস্পর্শে থাকতে হয়, তারা যেমন করোনা সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তেমনি যাত্রীরাও ঝুঁকিতে থাকেন। সেই বিবেচনায় গণপরিবহন বন্ধ রাখা যুক্তিসঙ্গত। তবে সেক্ষেত্রে পরিবহন শ্রমিকদের জীবিকার নিশ্চয়তার বিধানও করতে হবে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন যানবাহনে বাড়ি ফেরার চেষ্টায় আছে মানুষ। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যদিকে তাদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ও নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তার চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের সুযোগ করে দিলে যাত্রীদের করোনা ঝুঁকি কমবে।

মোট ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালু রাখার পক্ষে মত তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরাও। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও অর্ধেক যাত্রী নিয়ে দূরপাল্লার চালুর পক্ষে মতামত প্রকাশ করেছিলে। জুনের শেষ সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তারা এ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সভায় বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ ফিনিসড লেদার গুডস্ অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

নিট গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি সেলিম ওসমান ওই সভায় বলেন, ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষ যেন সুন্দরভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন, সে লক্ষ্যে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালু রাখা প্রয়োজন।

ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মানুষের ঘরে ফেরা ঠেকাতে না পারার প্রসঙ্গটিও উঠে আসে সভায়।

ওই সভায় আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, করোনার কারণে গত  ঈদুল ফিতরের সময় তিন দিন ছুটি দেওয়া হয়েছিল। যাতে ঢাকা থেকে মানুষ গ্রামমুখী না হয়। সেজন্য সড়ক ও মহাসড়কে বাধা দেওয়া হলেও ঈদের ছুটিতে মানুষের যাতায়াত বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ঈদের ছুটিতে মানুষের মধ্যে নিজ গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। তাই মানুষের নিরাপদে যাতায়াতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বিভিন্ন সড়কের সংস্কার কাজ শেষ করার প্রস্তাব রাখেন।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ঈদের সময় গণপরিবহন বন্ধ থাকলে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে, অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে চলাচল করে থাকেন তারা। তিনি জানান, গত ঈদুল ফিতরের সময় ফেরিঘাটগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। ফেরিঘাটে আসার সাথে সাথে মানুষ উঠে পড়ায় কোনো পরিবহন তাতে উঠতে পারছিল না।

দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ বছর ৪ জুলাই তা ১৫ হাজার ছাড়ায়। এরপর মাত্র পাঁচ দিনে মৃতের সংখ্যায় যোগ হয় ১ হাজার জন।

তিনি বলেন, তৈরি পোশাক ও শিল্প কারখানার শ্রমিকদের এক সঙ্গে ছুটি দেওয়া হলে সাভার ও গাজীপুরে মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চলাচল করবে, যানজট বাড়বে। তৈরি পোশাক ও বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে ছুটি দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম ওই সভায় ঈদের সময় গণপরিবহন বন্ধ থাকলে মানুষ গাদাগাদি করে যাতায়াত করবে ও এতে সংক্রমণের হার বেশি হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস ও ট্রেন যোগাযোগ সচল রাখলে সংক্রমণ কম হতে পারে।

দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ১ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তা আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। কঠোর লকডাউন সফল করতে দূরপাল্লার পরিবহনসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন