সিআরবিতেই হাসপাতাল করবে রেলওয়ে, বিশিষ্টজনদের না

সিআরবিতেই হাসপাতাল করবে রেলওয়ে, বিশিষ্টজনদের না

এইদিকে, চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজন ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টজনরা। তারা বলছেন, হাসপাতাল সিআরবি নয়, চট্টগ্রামের অন্য কোথাও হোক।

এ বিষয়ে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিআরবিতে হাসপাতাল করার উদ্যোগটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সিআরবি হচ্ছে চট্টগ্রামের ফুসফুস। ফুসফুসকে ধ্বংস করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল দরকার নেই। সিআরবির ঐতিহ্য আছে। হাসপাতাল নির্মাণ হলে তা থাকবে না। মানুষের মুক্ত শ্বাস নেওয়ার জায়গা হলো এটি। সবশ্রেণির মানুষ সিআরবিতে গেলে স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে। হাসপাতাল হলে সেই সুযোগটি আর থাকবে না।

তিনি বলেন, এ জায়গাটিতে হাসপাতাল হলে এখান থেকে বিতাড়িত হবে প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ, কাটা পড়বে গাছগাছালি, তৈরি হবে মেডিকেল বর্জ্য, গড়ে উঠবে দোকানপাট। এভাবে একবার বাণিজ্যিক আগ্রাসন শুরু হলে সেটা আর আটকানো যাবে না।

তিনি আরও বলেন, গাছ কেটে হাসপাতাল নির্মাণ মানে অক্সিজেনকে ধ্বংস করা। হাসপাতাল করা মানে কার্বনের ব্যবসা শুরু করা। কোনো যুক্তিতেই সবুজের বিকল্প ইট পাথর হতে পারে না। এখানে কেনো হাসপাতাল করতে হবে। রেলের আরও অনেক জায়গা আছে, চট্টগ্রাম। অন্য জায়গায় হাসপাতাল তৈরি করা যেতে পারে। যে কোনো মূল্যে চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ সবুজের বিকল্প ইট, কাঠ-পাথর হতে পারে না। হাসপাতাল করলে হাসপাতালের বর্জ্যে আশেপাশের পরিবেশও নষ্ট হবে।

এদিকে, সোমবার (১২ জুলাই) চট্টগ্রামের ১৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে সিআরবিকে ‘নগরীর ফুসফুস’ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাবিত স্থানের পরিবর্তে অন্য কোথাও হাসপাতাল নির্মান করার আহ্বান জানান।

বিবৃতিদাতারা হলেন- শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী, ড. অনুপম সেন, ড. মু সিকান্দার খান, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অধ্যাপক আবুল মনসুর, কবি- সাংবাদিক আবুল মোমেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, ডা. এ. কিউএম সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক হরিশংকর জলদাস, অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীম, ডা. চন্দন দাশ, নাট্যব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার, অধ্যাপক অলক রায়, স্থপতি জেরিনা হোসেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার ও আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান।

বিবৃতিতে বলা হয়, সিআরবি, সাত রাস্তার মোড় ও টাইগার পাস ঘিরে থাকা পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালামণ্ডিত এলাকাটি চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই গণ্য। এখানে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে বহুতল হাসপাতাল নির্মাণের চুক্তি সম্পাদন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। খবরটি চট্টগ্রামের অপমার মানুষকে অত্যন্ত ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্দ করেছে। হাসপাতাল করলে এলাকার পরিবেশকে প্রভাবিত করবে। এছাড়া এলাকায় জনসমাগম বাড়বে। এতে সিআরবির স্বাভাবিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হবে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, ওই এলাকায় ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহীরা অর্থসংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিয়েছিল। এছাড়া সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিলীয়মান নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্যকলা। ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব বিবেচনা থেকেই এলাকাটিকে বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ২য় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে।

বিবৃতিতে বিশিষ্টজনরা বলছেন, আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধী নই। কেবল একটি প্রাকৃতিক কারণে সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্থানে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অনুচিত বলে মনে করছি। চট্টগ্রামে আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন আছে, তবে তা উপযুক্ত স্থানেই নির্মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা অবিলম্বে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ থেকে সংশ্লিষ্টদের সরে আসার আহ্বান জানান। না হলে বৃহত্তর আন্দোলন ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।

এদিকে এর আগে শনিবার (১০ জুলাই) সিআরবি রক্ষার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণর নামে সিআরবি এলাকার শতবর্ষী গাছগুলোকে কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। মূলত শিরিষতলাকে কেন্দ্র করে বাঙালির সংস্কৃতির যে মিলনমেলা সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে সুকৌশলে বানচাল করতে চায় রেলওয়ের কতিপয় কর্মকর্তা। তিনি সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের হটকারী সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য রেলওয়েসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আহ্বান জানান।

এদিকে চুক্তি করলেও সিআরবিতে হাসপাতাল চান না খোদ রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এরই মধ্যে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। তাদের দাবি এ ধরনের হাসপাতাল করার মতো চট্টগ্রাম নগরীতে রেলওয়ের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সিআরবিতে না করে, অন্যত্র হাসপাতালটি হতে পারে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি শেখ লোকমান হোসেন দৈনিক আগামীর সময়কে বলেন, আমরাও সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল চাই না। চট্টগ্রামে রেলওয়ের অনেক জায়গা আছে, সেখানে হাসপাতাল করা হোক। সিআরবিতে এখন একটি সুন্দর পরিবেশ আছে, হাসপাতাল তৈরি হলে আর এ পরিবেশ থাকবে না। এছাড়া সিআরবিতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান কার্যালয় রয়েছে। যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রেলের প্রয়োজনে এ জায়গাগুলো আবার লাগতে পারে।

তিনি বলেন, হাসপাতালে যেখানে করা হবে এর পাশেই রেলওয়ে কলোনি আছে। হাসপাতাল থেকে যে কোনো রোগ ছড়াতে পারে। এলাকার পরিবেশ হাসপাতালের বর্জ্যে নষ্ট হবে। এখানে হাসপাতালে না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, মানুষ সকাল-বিকেল স্থানটিতে ভ্রমনণ করে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। হাসপাতাল তৈরি হলে সব বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এখানে হাসপাতাল আশা করি না।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘যেহেতু চুক্তি হয়েছে, হাসপাতালের কাজ  শুরু হবে। হাসপাতালের জন্য যে স্থানটি নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে হাসপাতালে না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখানে হাসপাতাল করলে পরিবেশ ও ঐতিহ্যের কোন ক্ষতি  হবে না। হাসপাতাল তো সমতল জায়গায় হবে, পাহাড়ে হবে না। যারা পরিবেশের কথা বলে বিরোধিতা করছে, তাদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার না। এখানে কোনো শতবর্ষী গাছ কাটা পড়বে না।’

সিআরবি এলাকায় হাসপাতালের বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকোশলী কাজী হাসান বিন শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতাল করার জন্য এখনও সিডিএতে কোনো ধরনের আবেদন করেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে আমরা কোনো ধরনের বেআইনি অনুমতি দেবো না। সবকিছু দেখা উপযুক্ত মনে হলে অনুমতি দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, অনুমতি দেওয়ার আগে আমরা দেখবো তারা কোনো গাছ কাটবে কিনা। সিআরবি চট্টগ্রামের একটি দর্শনীয় স্থান। স্থাপনা করতে গিয়ে দর্শনীয় স্থানের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের। তারা যদি আবেদন করে সবগুলো বিষয় খতিয়ে দেখবো। এছাড়া এখানে যে শতবর্ষী গাছ আছে, এগুলো যাতে কাটা না পড়ে সে বিষয়গুলো খেয়াল রেখা হবে।

তিনি বলেন, রেলের অনেক জায়গা থাকতে সিআরবিতে কেন হাসপাতাল করতে হবে, বিষয়টা বুঝে আসতেছে না। অন্য যে কোনো জায়গায় তারা হাসপাতাল করতে পারে।

আপনি আরও পড়তে পারেন