‘চাকরিজীবী লীগ’ই কাল হলো হেলেনা জাহাঙ্গীরের

‘চাকরিজীবী লীগ’ই কাল হলো হেলেনা জাহাঙ্গীরের

১২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন। গড়ে তুলেছেন প্রায় আধাডজন প্রতিষ্ঠান। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পদও ছিল। যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীর। বর্তমানে তিনি র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) হাতে আটক আছেন। ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের নাম ছড়িয়ে পড়ার পরই হেলেনার রাজনৈতিক জীবনে আচমকা এমন বাঁকবদল এলো।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) রাত ৮টার পর হেলেনা জাহাঙ্গীরের গুলশান-২ এর ৩৬ নম্বর রোডের বাসভবনে অভিযান শুরু করে র‍্যাব। দীর্ঘ চার ঘণ্টা অভিযান শেষে রাত ১২টার দিকে তাকে আটক করা হয় এবং পরে র‍্যাব সদরদফতরে নিয়ে যাওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার পর হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান শেষে র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। তার বাসায় বিপুল পরিমাণের মাদকসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র জব্দ করা হয়েছে। তাকে আমরা আটক করে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‍্যাব সদরদফতরে নিয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠনের পোস্টার ভাইরাল হলে আলোচনায় উঠে আসেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। পোস্টারে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হেলেনা জাহাঙ্গীর আর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মনিরের নাম উল্লেখ করা হয়। এরপরই আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদ হারান হেলেনা। ২৫ জুলাই দলটির মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য সচিব মেহের আফরোজ চুমকি স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এর আগে ২৪ জুলাই মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বারবার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় হেলেনা জাহাঙ্গীরের সদস্য পদ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটি থেকে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তবে ‘চাকরিজীবী লীগ’ নামের সংগঠনে সদস্যপদ দেওয়ার কথা বলে বেশ কয়েকজনের কাছে হেলেনা টাকা দাবি করেন। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

‘চাকরিজীবী লীগ’ই হেলেনার কাল হলো বলে মনে করছেন অনেকে। চাকরিজীবী লীগের মতো ভূঁইফোড় এমন সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দোকান আখ্যা দিয়ে গত ২৯ জুলাই দৈনিক আগামীর সময় প্রকাশিত মতামত কলামে বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা লিখেছেন, এই দোকানের সর্বশেষ আলোচিত নাম নারী ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরের চাকরিজীবী লীগ। আর এই নতুন দোকানকে সামলাতে না পেরে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটি থেকে বহিষ্কৃতও হলেন হেলেনা। প্রচলিত বাংলায় বলতে হয় হেলেনা ‘ধরা খেয়েছেন’। দলের ভেতরকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, আর কিছু এমপি মন্ত্রীর ব্যক্তিতন্ত্র এমন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যেন দলের ভেতর শুধু সিন্ডিকেট আর সিন্ডিকেট। এই অরাজনৈতিক চর্চার সুযোগেই দলের নামে শত শত ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। অসংখ্য হেলেনা জাহাঙ্গীরের আবির্ভাব ঘটেছে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে এরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, হেলেনাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা টেলিভিশন টক শো’তে এসে জানান তারা পুলিশ ও প্রশাসনকে বলেছেন, এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিল না কেন?

বৃহস্পতিবার রাতে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আটক করে র‍্যাব

তবে আওয়ামী চাকরিজীবী লীগের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। ২৪ জুলাই রাতে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার আওয়ামী চাকরিজীবী লীগের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, এখনো নেই। আমি কোথাও কী লিখেছি আমি আওয়ামী চাকরিজীবী লীগের সাথে সম্পৃক্ত? আমাকে প্রস্তাব দিয়েছে সভাপতি হতে। আমি বলেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে আমি সভাপতি হব। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘জীবনে আমি কখনও কোনো নিয়ম ভঙ্গ করি নাই, করার প্রশ্নই আসে না। একটা কু-চক্রী মহল মিথ্যা ও বানোয়াট নাটক দিয়ে নোংরামি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে মাত্র।’

হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় পাওয়া মাদক

এদিকে, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি দিয়ে ফেসবুকে হেলেনা নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ দলীয় নেতাকর্মীদের। এছাড়াও তিনি রাজনীতির নামে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির প্রয়াত এইচ এম এরশাদের সঙ্গে তোলা হেলেনা জাহাঙ্গীরের ছবিও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

এ বিষয়ে সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে হেলেনা বলেছিলেন, ‘আমি যে কারো সঙ্গেই ছবি তুলতে পারি। এর মানে এই না যে, আমি বিএনপি বা জাতীয় পার্টির রাজনীতি করি। আমি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার রাজনীতি করি।’

প্রিন্টিং, অ্যামব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, স্টিকার এবং ওভেন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে পরিচিতি রয়েছে হেলেনা জাহাঙ্গীরের। জয়যাত্রা গ্রুপের আওতায় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পুরস্কৃতও হয়েছেন রোটারি ক্লাবের একজন ডোনার হিসেবে। জয়যাত্রা নামে একটি আইপি টেলিভিশনেরও মালিক এই হেলেনা জাহাঙ্গীর। তবে জয়যাত্রা টিভি কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই চলতো বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) দিবাগত রাতে মিরপুর-১১ নম্বরের এ ব্লকের ৩ নম্বর রোডে জয়যাত্রা টিভি কার্যালয়ে অভিযান শেষে র‍্যাব সদরদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাদির শাহ বলেন, মিরপুরে জয়যাত্রা টিভি কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। চ্যানেলটির কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না। যদিও সম্প্রচারের জন্য চ্যানেলের যে সেটআপ থাকা দরকার, তার সবকিছুই রয়েছে।

তিনি বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর তার জয়যাত্রা টেলিভিশনের জন্য সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছিলেন। প্রবাসী প্রতিনিধি নিয়োগের নামে তিনি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বৈধ কাগজপত্র না পাওয়ায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও এখানে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের অফিস পেয়েছি। এ বিষয়েও তদন্ত করা হবে।

চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে র‍্যাবের এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, অধিকতর তদন্ত করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তদন্ত করে যদি বৈধ কাগজপত্র না পাওয়া যায়, তাহলে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন