হারিয়ে যাচ্ছে ভৈরবের মিঠা পানির দেশীয় প্রজাতির মাছ

হারিয়ে যাচ্ছে ভৈরবের মিঠা পানির দেশীয় প্রজাতির মাছ

এম আর ওয়াসিম, ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ

হাওরাঞ্চলের প্রবেশপথ বলে খ্যাত কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বিগত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে মিঠাপানির মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চলসহ এখানকার নদ-নদী ও খাল বিলের স্বাদুপানির দেশীয় মাছ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে চাহিদা বাড়লেও ক্রমেই কমে আসছে মাছের জোগান। ফলে বাজারে মাছের দাম চলে যাচ্ছে ক্রেতা-সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ বহুল প্রচলিত প্রবাদটি কেবল জায়গা করে নিচ্ছে বইয়ের পাতায়। অন্যদিকে এ অঞ্চলে বংশ পরম্পরায় মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা প্রয়োজনীয় মৎস্য আহরণ করতে না পারায় বাধ্য হচ্ছে মানবেতর জীবনযাপনে।

তবে স্থানীয় মৎস্য বিভাগের অভিমত, মুক্ত জলাশয় অর্থাৎ নদী-নালার মৎস্য সম্পদ কমে এলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে বদ্ধ জলাশয়ে মাছের আবাদ। জিহ্বার স্বাদ কমে এলেও পুষ্টির কোনো ঘাটতি হবে না এখানকার অধিবাসীদের।

কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চলসহ ভৈরবে এক সময় মাছের ভান্ডার বলে পরিচিত ছিল। ভৈরবসহ আশে পাশে বড় নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কালী,ও শীতলপাটিসহ অসংখ্য হাওর-বাওর, নালা, খাল-বিলে তারা বাইম, কৈলাশ, কালী বাউশ, চিতল, নানীন, ভাচাঁ, গাওরা, গাগলা, পাবদা, বাগাই, রিডা, পুমা, লাচু, টেকা, কাজলী, বেদী বা মিনি, কাদলা, কাইক্কা, পাঙাস, মৃগেল, শিং, মাগুর, কৈ, চান্দা, বাইল্লা, টেংরা, বাতাসি বা আলনি মাছ,বইছা,গুতুম ,চিকরা, চাপিলা, রানী বা রানদী, ভূম মাছ, আকস মাছ, পান মাছ, মাসুল মাছ, কোরাল মাছ, তিতপুঁটি, কাচকিসহ ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের সহজ লভ্যতা ও প্রাচুর্য্যতা ছিল এখানে। খেতে খুব স্বাদ হওয়ায় এখানকার মাছের কদর ছিল পুরো দেশ ছাড়াও দেশের বাহিরে । কিন্তু যতই সময় পার হচ্ছে এখানকার মাছের ভান্ডারের শূন্যতাও দেখা দিচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেকগুলো আবার প্রায় বিলুপ্তির পথে।

স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানায়, বর্তমানে আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ মাছও নেই নদী-নালা আর খাল-বিলে। তাই তারা সারাদিন শিকার করেও দুইশ টাকার বেশি মাছ শিকার করতে পারে না। আর মাছ না থাকায় বাড়ির ঘাটে সারাদিন অলস বাঁধা থাকে তাদের মাছ শিকারের নৌকাগুলো। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের এ অসহনীয় বাজারদরে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। অন্য কোনো উপায় না থাকায় এ পেশায় লেগে আছে বলেও জানায় জেলেরা।

নদ-নদীতে মাছ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সাধারন জেলেরা ও সুধী সমাজেরা জানায়, নদীতে সময়মত পানি না আসা, এক শ্রেণীর লোভী ও অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেরা পোনা মাছ নিধন করা, অবৈধ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে সকল প্রকার মাছ শিকার করা। এছাড়া জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, কল-কারখানার বর্জ্য, মাছের আবাসস্থল বিনষ্ট হয়ে যাওয়া, সেচ দিয়ে মাছ ধরে ফেলাসহ অসংখ্য মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে ।

ভৈরবের কালিপুর গ্রামের আবু কালাম, ইসমাইল, আক্তার মিয়া, মামুন, রেনু মিয়া, হক মিয়া, আলমগীর মিয়া, কাসেম মিয়া, রমযান মিয়ারা জানায়, এক সময় তারা জাল ও বরশি ছাড়াও ডুব দিয়ে বিল থেকে মাছ ধরতেন। এছাড়া আগে যে জায়গায়ই বরশি দিয়ে লর ফেলতেন সেই জায়গাই মাছ ধরত কিন্তু এখন আর সেই দিন যেমন তেমন সেই জায়গাও নাই সব বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছে। আবার তারা যখন জাল দিয়ে মাছ ধরতেন তখন জাল থেকে মাছ খোলার জন্য বাড়িতে এক জাল রেখে আরেক জাল নিয়ে যেত মাছ বেশী ধরা পড়ার কারণ বাড়িতে মহিলারা মাছ খোলত আর তারা আরেক জাল নিয়ে আবার নদীতে ফেলত । আবার দেখা যেত মাছ বাজারে যেই মাছ একটু বেশী আমদানী হতো সেই মাছ ব্যবসায়ীরা আর ক্রয় করতনা তাই সেগুলো তারা নদীতে ফেলে দিতো। তবে ঐসময় মাছের দাম কম থাকায় আর মাছ বেশী আমদানী থাকায় সবার ঘরে ঘরে মাছ থাকত। কিন্তু এখন আর সেই দিন নাই, মাছতো দুরের কথা মাছের গন্ধও পাওয়া যায়না সহজে।

নয়াহাটি গ্রামের লিবৃন্দ্র, সুরেশ বর্মণ, তরণি বর্মণ ও অরুণ চন্দ্র বর্মণ, এবং মহেশপুরের জালাল উদ্দিন ,সাদির মিয়া, হরলাল দাস ও অরিত্র লাল দাস জানান, তাঁরা তাঁদের শৈশবে দেখেছেন পানির ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভেসে বেড়াত। এখন সেই দৃশ্য কল্পনায়ও ভাসে না! তারা আরো জানান, আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও এক ঘণ্টা জাল টানলে এক-দেড় মণ মাছ উঠত জালে। এখন দিন-রাতেও এর সিকি ভাগও হয় না। এছাড়া প্রভাবশালী মহল মাঝ নদীতে খেউ আর বাঁধ দিয়ে এবং পাটিজাল পেতে মাছ শিকার করে। তাদের ধারে কাছেও যেতে পারে না জেলেরা।

সকালে পৌর শহরের পুরাতন ফেরীঘাটের পংকু মিয়ার মাছ বাজার আর বিকালে পলতাকান্দা মাছ বাজারের মাছ বেপারী পুষন বর্মন,শাহজান মিয়া, দিনইসলাম মিয়া ও ফারুক মিয়া জানায়,তারা একেকজন ৪০-৪৫ বছর যাবত মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাছের এমন আকাল এই অঞ্চলে তাদের চোখে আর পড়েনি। দিন যতই যাচ্ছে, দেশীয় মাছের সংকট আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। জলে মাছ নেই। বাজারে মাছের আমদানি কম। আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ দেশী মাছও এখন আমদানি হয় না। ব্যবসা নেই। তাই লাভও হয়না। ফলে মাছ বেপারীদেরও দিন-কাল ভালো নেই। এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল থেকে বহু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় দেশী মাছের সরবরাহ কমে গেছে বলেও জানায় তারা। তবে চাষ করা মাছের আমদানী থাকায় এলাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তরা কিছুটা মাছ খেতে পারেন।

ভৈরব উপজেলায় ৪টি নদ-নদী, ১৮টি বিল ছাড়াও ছোট বড় ১৪৫০টি পুকুড় রয়েছে যেখানে ৬৬২০.৮০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। যা বর্তমানে মাছের ঘাটতি পূরণ করে ৭ মেট্রিক টন মাছ আরও বেশী পরিমাণে থাকে বলে জানালেন ভৈরব সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ লুতিফুর রহমান। তিনি আরও জানায়, ভৈরব হাওড় ও নদী বৃষ্ঠিত এলাকা হওয়ায় মাছের সাথে ভৈরবের একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে এখানে যে হাওড় বা নদীনালা রয়েছে সেখানে প্রাকৃতিক মাছগুলো বিভিন্ন কারণে কিছুটা কমতি বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারি ভাবে আমরা মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সম্মৃদ্ধির লক্ষে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। আর আমাদের একটি অভায়শ্রম রয়েছে এবং আরও দুটি অভায়শ্রমের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছি, যদি এই প্রস্তাব সফল হয় তাহলে আশা করি মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে । তাছাড়া আমরা বিভিন্ন মৎস্য সম্প্রদায়ের সাথে মতবিনিময় করেছি যেন তারা অবৈধ জাল দিয়ে মাছ না ধরে এবং আমরা বিভিন্ন অভিযান চলমান রেখেছি । এছাড়া উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা ছেড়ে মাছের উৎপাদন ও বিলুপ্ত মাছগুলোর বংশ বৃদ্ধি জন্য কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছ বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে এই বিভাগ। আশা করি এই সব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের হারিয়ে যাওয়া মাছগুলো ফিরে আসবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন