মেয়রদের মান কতটা রাখবে ঢাকা নগর পরিবহন?

মেয়রদের মান কতটা রাখবে ঢাকা নগর পরিবহন?

গতকাল (মঙ্গলবার) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে কাউন্টারের সামনে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন অল্প কয়েকজন মানুষ। টিকিট কাটার পর বাসের জন্য প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। এরপর সেখানে এসে দাঁড়াল দোতলা একটি বিআরটিসি বাস। পুরো বাসে ৩০ জনের মতো যাত্রী দেখা গেল।

৫০টি বাস দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে এ সেবা। এখানে বিআরটিসির ছাড়া বাকি যে বাসগুলো রয়েছে সেগুলো সবুজ রঙের। চালকের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সবুজ ইউনিফর্ম, গলায় থাকছে আইডি কার্ড। প্রেসক্লাবের সামনের কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতার গলাতেও  আইডি কার্ড ঝুলতে দেখা গেছে। পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম একটা সেবা দেওয়ার চেষ্টা কর্তৃপক্ষের রয়েছে তা স্পষ্ট।

যাত্রীদের চোখে ঢাকা নগর পরিবহন
২১ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটে যে কোনো গন্তব্যের জন্য ন্যূনতম ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা, আর সর্বোচ্চ ভাড়া ৫৯ টাকা। কিলোমিটার প্রতি ভাড়া পড়ছে ২ টাকা ২০ পয়সা করে।

নুবায়েত প্রত্যয় নামে একজন যাত্রী দৈনিক আগামীর সময়কে বলেন, আমি মোহম্মদপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত রজনীগন্ধা বা মালঞ্চ বাসে যাতায়াত করতাম। এই বাস দেখে ভাবলাম, যেহেতু নতুন ভালোই হবে। আর গেটলকও। টিকিট কাউন্টারের সাজ দেখে মনে হলো ভাড়া বেশি হতে পারে। কিন্তু দেখলাম মোহম্মদপুর থেকে গুলিস্তান অন্যান্য বাসের মতো ২০ টাকাই ভাড়া। চলতি পথে দেখলাম এই বাসের আগে ছেড়ে আসা রজনীগন্ধা কয়েক সিগন্যাল পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ধাক্কাধাক্কির ঝামেলা নেই, আরামদায়ক সার্ভিস।

তামান্ন আলম নামে একজন ফেসবুকে ট্রাফিক এলার্ট গ্রুপে লিখেছেন, নগর পরিবহনের বাসে যাতায়াত করার চেষ্টা করছি। আলহামদুলিল্লাহ সার্ভিস সন্তোষজনক। আগের সময়ের চেয়ে এখন সময়টা কম লাগছে। কিন্তু বাসে যাত্রী কম। সবারই কম বেশি উচিত এই বাসে ওঠা। তাহলে আমাদের জন্যেই ইনশাআল্লাহ ভালো হবে।

নগর পরিবহনের একটি বাসের চালক নাসিম দৈনিক আগামীর সময়কে বলেন, যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা সিস্টেমের মধ্যে এলে যাত্রী হয়রানি বন্ধ হবে। এখন যাত্রী কম-বেশি মিলিয়ে পাচ্ছি। তবে কখনও যাত্রীতে বাস ফুল হয়নি। আস্তে আস্তে সেটা হয়ে যাবে। এখনও অনেকে এই বাস সম্পর্কে জানে না। তাদের জানাতে হবে।

 

 

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মো. ইদ্রিস বলেন, এই সার্ভিসটি অনেক ভালো। মানুষ এখনও হয়তো এই সার্ভিসটি ভালোভাবে জানে না। তাই যাত্রী কম। দুপুর ২টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ২৩০০ টাকার টিকিট বিক্রি করা হয়েছে।

রোড ইনচার্জ সাব্বির আহমেদ দৈনিক আগামীর সময়কে বলেন, আমাদের এই রুটে মোট ৫০টি বাস চলে এখন। আমাদের বাস ভাড়া অন্যান্য বাসের চেয়ে কম। কারণ, আমরাই একমাত্র রুট পারমিট অনুযায়ী ভাড়া নিই। যেখানে ভাড়া ১২ টাকা, সেখানে আমরা ১২ টাকাই নিই। অন্যরা নেয় ১৫/২০ টাকা। আমাদের যাত্রী এখন কম। আরও কিছুদিন গেলে যাত্রী আরও বাড়বে। আমাদের সেবার মান আরও উন্নত হবে। আর এটার জন্য প্রয়োজন প্রচারণার। একমাত্র প্রচারণাই পারে আমাদের এই সার্ভিসে যাত্রী বাড়াতে।

প্রয়োজন ব্যাপক প্রচারণা
নতুন এ কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা একটা নতুন সার্ভিস, এই সার্ভিসটাকে অবশ্যই আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। এর আগে রাজধানীতে চক্রাকার বাস সার্ভিসসহ অন্যান্য সার্ভিসগুলোর মতো যেন এই সার্ভিসটি বিলীন না হয়ে যায়।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়িলি যুক্ত হয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের

তিনি আরও বলেন, এই নতুন সার্ভিসে যাত্রী কেন কম হচ্ছে, সেই বিষয়টা তারা অবশ্যই গবেষণা করবেন এবং সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেবেন। তাহলে কেবল এই প্রকল্পটি জনপ্রিয় হতে পারে। অন্যান্য পরিবহন থেকে মানুষ কেন এই পরিবহনটি ব্যবহার করবে, কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে সেই বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এটার জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা প্রয়োজন। আমি হলফ করে বলতে পারি, যাত্রীরা যদি এই বাসের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানতে পারেন, তবে তারা অবশ্যই বাসটা ব্যবহারে প্রাধান্য দেবেন।’

কেন যাত্রী কম ও প্রচারণার বিষয়ে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন কী ভাবছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের দৈনিক আগামীর সময়কে বলেন, ‘আমার জায়গা থেকে আমি যেটা মনে করি, প্রত্যেকটা নতুন ব্যবস্থাপনায় মানুষ একটু সংশয় প্রকাশ করেন। সেই জায়গা থেকে আমাদের গণমাধ্যমগুলো যদি বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে এবং বেশি বেশি মানুষের সামনে নিয়ে আসে তাহলে এই নতুন ব্যবস্থাপনাকে একটি মজবুত ভিত্তি দেওয়া সম্ভব। কারণ, এটা পাইলট প্রকল্প। এর সফলতা এবং ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করবে ঢাকা সিটির নগর পরিবহনের ভাগ্য। আমাদের জন্য যদি আপনাদের কোনো পরামর্শ থাকে, তবে সেটা আমাদের জানাবেন। আমরা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন। এটাতে দক্ষিণের মেয়র মহোদয় কনভেনোর এবং উত্তরের মেয়র মহোদয় কমিটির সদস্য। এই কমিটিতে আরও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার আছেন, যারাও সদস্য। সেই হিসেবে বলা যায় এটা উচ্চপর্যায়ের একটা শক্তিশালী কমিটি। কিন্তু এটা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে আমাদের ডিটিসিএ। যদি এটা সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন থাকতো, তাহলে আমাদের পার্সোনালি ফোর্সটা বাড়িয়ে দিতাম। তারপরও প্রচারের বিষয়টা আমি মেয়র মহোদয়কে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বলব।’

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতারের সঙ্গে কথা বলতে তাকে ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীতে তাকে আরও কয়েকবার কল করলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

২৬ ডিসেম্বর ‘ঢাকা নগর পরিবহন’কোম্পানির বাস চলাচলের উদ্বোধন করেন ঢাকার দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য গঠিত কমিটির বর্তমান সভাপতি শেখ ফজলে নূর তাপস।

বিআরটিএ’র হিসাবে বর্তমানে রাজধানীর ২৯১টি রুটে চলাচল করা বাসের সংখ্যা ৯ হাজার ২৭টি। ঢাকার জন্য কোম্পানিভিত্তিক বাস সেবা প্রবর্তনের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে তাতে বাসের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত হাজার ৩৩৫টি।  প্রকল্প সফলতার মুখ দেখলে পর্যায়ক্রমে ঢাকার সব রুটেই এই ব্যবস্থা চালু হবে। ঢাকার পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে মেয়রদের হাত ধরে আসা এই উদ্যোগ সফল হবে না কি আরও অনেক প্রকল্পের মতো বিলীন হয়ে যায় সেটা বলে দেবে সময়।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন