প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হালাল বা বৈধ খাবার গ্রহণ করা অপরিহার্য। হাদিসের ভাষায় হালাল খাবার গ্রহণ দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত। কোরআনের বহু আয়াত ও হাদিসে বারবার হারাম খাবার থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ কোরো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করল, বিক্ষিপ্ত চুল, ধুলাবালিযুক্ত শরীর, দুই হাত আসমানের দিকে উঠিয়ে দোয়া করতে থাকে : হে প্রভু! হে প্রভু! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারাম দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করা হয়েছে। তাহলে কিভাবে তার দোয়া কবুল করা হবে?’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৮৬)
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অস্বাস্থ্যকর খাবার হারামের পাশাপাশি ইসলাম পবিত্র, স্বাস্থ্যসম্মত ও উপকারী সবধরনের খাবার গ্রহণে উৎসাহ দিয়েছে। মূলত ইসলাম অপবিত্র ও অবৈধ পানাহার নিষিদ্ধ করেছে।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলেন, ‘আপনি বলে দিন, যা কিছু বিধান ওহির মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, আহারকারী যা আহার করে তাতে তার জন্য আমি কোনো হারাম খাবার পাই না; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস— এটা অপবিত্র অথবা অবৈধ। (সুরা আনআম, আয়াত : ১৪৫)
সাধারণত যেসব খাবার আমরা গ্রহণ করে থাকি, তা দুই প্রকার। একটি পশু-পাখি, অপরটি উদ্ভিদ ও শাকসবজি। এসব খাবারের ভেতর কী কী হারাম বা জায়েজ নেই— তা জেনে রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি খেয়াল রাখলে হালাল-হারাম বুঝতে পারা সহজ।
যেসব পশু-পাখি খাওয়া হারাম
পশু-পাখির ক্ষেত্রে কিছু নিদর্শন ও বিধি-বিধান লক্ষ্য করলে হালাল-হারাম নির্ণয় করা সহজ। যে প্রাণীতে হারামের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাবে, তা খাওয়া জায়েজ নেই।
দাঁতবিশিষ্ট হিংস্র জন্তু : যেমন- বাঘ-সিংহ, নেকড়ে বাঘ, চিতা বাঘ, হাতি, কুকুর, শিয়াল, শূকর, বিড়াল, কুমির, কচ্ছপ, সজারু ও বানর ইত্যাদি।
পাঞ্জাধারী হিংস্র পাখি : যেমন, ঈগল, বাজ, শ্যেন, পেঁচা ইত্যাদি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) দাঁতবিশিষ্ট প্রত্যেক হিংস্র জন্তু ও নখ দিয়ে শিকারকারী প্রত্যেক হিংস্র পাখি খেতে নিষেধ করেছেন। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১৯৩৪)
নির্দিষ্ট কিছু পশু : নির্দিষ্টভাবে যেসব পশু খেতে নিষেধ করা হয়েছে, তা খাওয়া হারাম। যেমন, গৃহপালিত গাধা। জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) খায়বরের দিন গৃহপালিত গাধা খেতে নিষেধ করেছেন এবং ঘোড়ার গোশত খেতে অনুমতি দিয়েছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৪২১৯; মুসলিম, হাদিস : ১৯৪১)
আরেকটি উদাহরণ, শূকর। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃতপ্রাণী, রক্ত ও শূকরের গোশত।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৩)
নোংরা ও নাপাক কোনো কিছু : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তাদের জন্য তিনি (রাসুল) পবিত্র বস্তু হালাল করেন আর অপবিত্র বস্তু হারাম করেন।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৫৭)
যেমন- মৃত জন্তু, পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ, প্রবাহিত রক্ত এবং সেসব খাবারে কোনো প্রকার উপকার নেই যেমন বিষ, মদ, খড়কুটা, মাদকদ্রব্য, তামাক ও অন্যান্য নেশজাতীয় দ্রব্য ইত্যাদি।
শরিয়তকর্তৃক নিষিদ্ধ প্রাণী : যেসব প্রাণী হত্যা করতে শরিয়ত নিদের্শ দিয়েছে বা যেসব প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেছে, তা খাওয়া হারাম। যেমন- ইঁদুর, সাপ, টিকটিকি, বিচ্ছু, কাক, চিল ইত্যাদি। কারণ, হাদিসে এগুলোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ইসলামকর্তৃক নিষিদ্ধ প্রাণীও হারাম; যেমন- হুদহুদ, দোয়েল, ব্যঙ, পিঁপড়া ও মৌমাছি ইত্যাদি।
জবাইয়ে আল্লাহ নাম না নিলে : আল্লাহ নাম নেওয়া ছাড়া জবাইকৃত হালাল পশু-পাখিও হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তা থেকে আহার করো না যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা সীমালঙ্গন।’ (সুরা আন-আম, আয়াত : ১২১)
অশুদ্ধভাবে জবাই হলে : হালাল প্রাণী জবাই শুদ্ধ না হলে, জবাইকৃত সে প্রাণীও হারাম। আবার জীবিত প্রাণী থেকে আলাদা করা গোশতও মৃত প্রাণীর মতো হারাম। জবাই করার কিছু ইসলামী নিয়ম-নীতি ও শর্ত রয়েছে। সেগুলো পূর্ণ না হলে, জবাইকৃত হালাল জন্তুও হারাম হয়ে যায়। যেমন- গরুর গলার নিচে জবাই করা বিধান; পাশাপাশি নির্দিষ্ট পরিমাণ রগ কাটাও হালাল হওয়ার পূর্বশর্ত। শর্ত পাওয়া না গেলে জবাইকৃত জন্তুও হারাম হয়ে যায়।
নোংরা পোকামাকড় : আর নাপাক বস্তু থেকে সৃষ্ট পোকা-মাকড় এবং যার শরীরে প্রবাহিত রক্ত নেই, সেগুলোও নাপাক। যেমন- তেলাপোকা ইত্যাদি।
মৃত প্রাণী ও প্রবাহিত রক্ত : সব ধরনের মৃত প্রাণী এবং প্রবাহিত রক্ত হারাম। তবে দুই ধরনের মৃত প্রাণী ও রক্ত হালাল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমাদের জন্য দু’প্রকার মৃত প্রাণী ও দু’প্রকার রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত প্রাণী হলো, মাছ ও পঙ্গপাল। আর রক্ত হলো, কলিজা ও প্লীহা।’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ৫৭২৩; ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৩২১৮)
হারাম ভক্ষণকারী জন্তু : যেসব পশু বা পাখির অধিকাংশ খাদ্যই নাপাক, সেগুলোর ওপর আরোহণ করা, সেগুলোর গোস্ত-ডিম খাওয়া এবং দুধ পান করা হারাম।
যেসব উদ্ভিদজাতীয় খাবার হারাম
খাদ্য ও পানীয়ের মূল প্রকৃতি হচ্ছে বৈধ ও হালাল হওয়া। সে সূত্রে বিভিন্ন উদ্ভিদ, ফল, শস্য ইত্যাদি থেকে তৈরিকৃত পানীয় হালাল। তবে যত ধরনের খাবার ও পানীয় নেশা তৈরি করে, তা খাওয়া বা পান করা জায়েজ নেই। যেমন, গাঁজা, আফিম, ইয়াবা, বিয়ার, শ্যাম্পেইন, হেরোইনসহ এ জাতীয় অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য।
এছাড়াও যা কিছু শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর, তাও জায়েজ নেই। যেমন- বিষ, সিগারেট ও এ জাতীয় অন্যান্য খাবার ও পানীয়। যেগুলোর ক্ষতি ও অপকারিতা সবার কাছে স্পষ্ট।
হারাম খাবার কখন খাওয়া যাবে?
কেউ যদি কঠিন খাদ্য সংকটে পড়ে এবং তার কাছে হালাল খাবারের মজুদ না থাকে। হারাম না খেলে সে মারা যাবে। এ অবস্থায় জীবিত থাকতে পারে সে পরিমাণ হারাম খাবার গ্রহণ বৈধ। তবে তা যদি বিষ হয় তবে তা নিষিদ্ধ আছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘সুতরাং যে বাধ্য হবে, অবাধ্য বা সীমালঙ্গনকারী না হয়ে, তাহলে তার কোনো পাপ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৭৩)
বাস্তবিকভাবে আল্লাহ তাআলা যা হারাম করেছেন, তা কেবল মানুষের উপকার ও কল্যাণার্থে। কিন্তু কিছু মানুষ অনেক সময় তা বুঝতে পারে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার ও মেনে চলার তাওফিক দান করুন।
-মুওসুআতুল ফিকহিল ইসলামী’র ‘আকসামুল আতইমা আল-মুহাররামা’ অবলম্বনে মুফতি আসিম নাজিব