কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে আদালতকে অবহিত করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। তারা আদালতকে জানান, মুনিয়াকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেলেও প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে এ মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার দূরে থাক, জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। এমনকি ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণে পরীক্ষার জন্য তার কাছ থেকে কোনো নমুনাও নেয়নি তদন্তকারীরা। মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা পার পেয়ে গেছে বলেও আদালতকে অবহিত করেন বাদীর আইনজীবীরা।
গতকাল বুধবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর বিচারক শওকত আলীর আদালতে বহুল আলোচিত মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২০ মার্চ নতুন তারিখ ধার্য করেছেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী নারাজি দেওয়ার ১৩ মাস পর গতকাল এ শুনানি অনুষ্ঠিত হলো। শুনানিকালে এজলাসে অঝোরে কাঁদেন মামলার বাদী ও মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। আদালতের কাছে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাকে আদালতে আসতে কয়েক দফা গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে। বোনের হত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে মামলা করায় প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীর ও তার সহযোগীরা তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।
শুনানিতে বাদীপক্ষের আইনজীবী পিবিআইর চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা তুলে ধরেন। এ সময় বারবার আসামিপক্ষ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। বাদীপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন ও অ্যাডভোকেট মাসুদ সালাউদ্দিনসহ কয়েকজন। আসামিপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদারের নেতৃত্বে কয়েকজন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট রেজাউল কবির রেজা।
বাদীপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে মুনিয়া প্রায় ৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরেই বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের ‘মর্যাদা’ রক্ষায় পুরো পরিবার মিলে চক্রান্ত করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বিচারক জানতে চান, এ সংক্রান্ত কোনো মেডিকেল রিপোর্ট আছে কি না? উত্তরে আইনজীবী জানান, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেই অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে অভিযুক্ত আনভীরের ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছে কি না বিচারক তা জানতে চাইলে আইনজীবী বলেন, অভিযুক্ত আসামি আনভীরকে গ্রেপ্তার বা কোনো জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি। বাদীপক্ষ থেকে বারবার আবেদন করা হলেও পুলিশ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করেনি। জিজ্ঞাসাবাদ না করা ও ডিএনএ পরীক্ষা না হওয়ার কথা শুনে বিচারক আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘কিন্তু সেটাই তো হওয়ার কথা।’ এ সময় বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া বলেন, ‘অথচ মামলার তদন্তকারীরা আমাকে টানা ৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।’ এই শুনানি চলাকালে পাশ থেকে অনেক আইনজীবী বলতে থাকেন, ‘প্রভাবশালীদের বিচার হয় না।’
২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ফ্ল্যাট থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া যায় যেখানে মুনিয়ার সঙ্গে আনভীরের প্রেম ও শারীরিক সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে লেখা ছিল। ওই সময় গুলশান থানায় মুনিয়াকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে আনভীরকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় আনভীরকে অব্যাহতি দিয়ে গুলশান থানা পুলিশ ২০২১ সালের ১৯ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই বছরের ১৮ আগস্ট ওই মামলার চার্জশিটও গ্রহণ করেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী ওই সময় পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মুনিয়ার পরিবারের করা অনাস্থা আবেদনও খারিজ করে দেন।
মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া এরপর আনভীরকে প্রধান আসামি করে মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করার অভিযোগ এনে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর আদালতে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, মুনিয়াকে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধে হত্যা করেছেন বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। অন্যরা এ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে নানাভাবে সহযোগী ছিলেন। আনভীর ছাড়া মামলার অপর আসামিরা হলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম, তার স্ত্রী আফরোজা বেগম, আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা, আনভীরের বান্ধবী সাইফা রহমান মিম, আনভীরের আরেক বান্ধবী মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, বাড়ির মালিক ইব্রাহিম আহমেদ রিপন ও তার স্ত্রী শারমীন। এরপর আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত চলাকালে পিবিআই মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও সাইফা রহমান মিমকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নেয়। পরে আসামিদের নির্দোষ দাবি করে পিবিআই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ২০২২ সালের অক্টোবরে। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের ওপর আদালতে নারাজি দেন নুসরাত জাহান তানিয়া।
শুনানি শেষে বাদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন বলেন, মুনিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। এবং তদন্তে তা সঠিকভাবে আসেনি সেটি আমরা আদালতকে বলেছি। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়েছি। আদালত আমাদের কথা শুনে আগামী ২০ মার্চ শুনানির দিন নির্ধারণ করেছেন। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে আমরা আশা করছি।