আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কিভাবে বাঁচানো যায়?

মোঃ আল মামুন খানঃ

জ্যৈষ্ঠ মাস যাকে মধু মাস বলা হয়, এলেই জামাইদের কদর বাড়ে। আসলে এই মাসে আম, জাম আর লিচুর মধুর রসে জামাইদের মনকে রঙিন করে দিতেই জামাই ষষ্ঠীর প্রচলন। তবে যে হারে বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে এই মধু মাসকে বিষাক্ত করা হচ্ছে, তাতে অচিরেই নির্দিষ্ট এই মাসটিকে ঘিরে জামাইদের উচ্ছ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আর যারা জামাইদেরকে মধুমাসে হৃদয়ের অনুপম মাধুরী দিয়ে স্নেহের নির্যাস স্বরূপ ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে চাইছেন- ফরমালিন আর কার্বাইড নামের কিছু ভয়ংকর দানব তাদের সেই আশার গুড়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে এটা কি আপনারা অনুভব করেন?।

প্রতি বছরই ফল পাকানোর জন্য বিষাক্ত কার্বাইডের ব্যবহারের কথা শুনে আসছি। একই সাথে খেয়েও চলেছি বিষাক্ত রাসায়নিক দেয়া সেই ফলমূল। আর দৈনন্দিন কাঁচা বাজারের সব্জীর কোনটিতে যে বিষাক্ত রাসায়নিক নেই তার উপর এক নাতিদীর্ঘ গবেষণা করা যেতে পারে। গার্মেন্টস শ্রমিক ভাই-বোনদের প্রতিদিনের নাস্তার আইটেম কলা-রুটি। দেশের ৪০ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিক প্রতিদিন কার্বাইড দিয়ে পাকানো কলা খেয়ে নিজের অজান্তেই শরীরে ঢুকাচ্ছেন বিষ। এমনিতেই এদের জীবনে সমস্যার অভাব নেই। তাই বিষাক্ত খাবার গ্রহনের দ্বারা জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলছে মুষ্টিমেয় কিছু লোভী দানবের লোভের যাতাকলে পড়ে।

একবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ছোট ভাইয়ের পোষ্টে খাবারে বিষ মেশানোর উপরে লেখা পড়েছিলাম। সেখানে মুড়ির ব্যাপারে জেনে বিষ্মিত হলাম। তাঁর পোষ্টে সে উল্লেখ করেছিলো- “মুড়িকে নরম, সুস্বাদু আর সাদা করার জন্য মেশানো হচ্ছে ইউরিয়া, সোডিয়াম কার্বনেট ও সালফার। কি আশ্চর্য, পবিত্র রমজানে রোজাদারদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে বরং ব্যবসায়িক ফায়দা বাড়ানোর জন্য এখন এসব কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে।”

একইভাবে, রাস্তার পাশে যে পপকর্ণ ভাজা হচ্ছে তাতেও বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। আর এই বিষ মেশানো পপকর্ণ অহরহ সাধারণ পাবলিক বাসে চলাফেরার সময় গ্রহন করছে এবং নিজেদেরকে বিরাট স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভিতরে ফেলছে।

এই বিষয়টি নিয়ে পত্রিকা ও মিডিয়াগুলোতে এতো বেশী আলোচনা হয়েছে যে, বাধ্য হয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এক যুগান্তকারি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলবাহী পরিবহনগুলোকে শহরে প্রবেশের মুখে আটকে দিয়ে নির্বিচারে সেগুলোকে ধ্বংস করার। তবে পরীক্ষার নামে যে ‘টেস্টিং কিটগুলো’ ব্যবহার করা হয়েছে তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে । আর এরই প্রভাব পড়ে খোলা বাজারে। খুচরা ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে কিংবা সরাসরি বাগান থেকে ফল কিনে এনে এভাবে ধ্বংসের নামে তাদের মুনাফা খুইয়ে সর্বশান্ত হয়। একপর্যায়ে তারা ধর্মঘটের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও বাধ্য হয়েছিলো যেটা গণমাধ্যমের ক্যলাণে আমরা দেখেছিলাম।

এখন আমাদের সামনে এই যে সর্বগ্রাসী স্বাস্থ্য ঝুঁকির সমস্যা উদ্ভুত হয়েছে, এর থেকে পরিত্রানের পথ কি? আছে কোনো কার্যকরি দিক নির্দেশনা। মাথা ব্যথা হলে মাথাকে কেটে ফেলাতেই সমাধান খুঁজলে তো সেটা বোকামির একশেষ হবে। ফলে বিষের জন্য ফল খাওয়াই বাদ দিলে কিংবা সব্জীতে ফরমালিনের বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে আমরা যদি সেগুলোকে খাওয়াই বাদ দেই, তবে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ আসবে কোথা থেকে?

আজ এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা না করলেই নয়ঃ-
>> UNDP রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের দেশের ৬৩% যুবক যাদের বয়স ২২-৪১ এর ভিতর। এদেরকে আমরা মোটিভেট করে স্থানীয়ভাবে কাজে লাগাতে পারি। এজন্য  রাজধানীকে কেন্দ্র করে ঢাকায় একটি সেন্ট্রাল কমিটি করতে হবে। আর ফলমূল যে জেলাগুলো থেকে আসে সেখানে লোকাল কমিটি করা যেতে পারে। এদের সবাইকে প্রথমে তিন দিনের এক ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।

>> উদাহরণস্বরূপ রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কথা বলা যেতে পারে। সাব-কমিটি প্রতিটি বাগান ভিত্তিক কার্যক্রম পরিদর্শন করবে। এরা বাগান মালিক এবং সাধারণ মানুষদেরকে সচেতন করবে। তবে সর্বাগ্রে বাগান মালিকদেরকে সচেতন হতে হবে এবং কার্বাইড মেশাবে না সে ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আর লোকাল প্রশাসন এই সাব-কমিটিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। না হলে অসাধু ব্যবসায়ি চক্রের ‘মাইর’ খেতে খেতে এই সাব-কমিটি অচিরেই বিলুপ্ত হবে।

>> এই সাব-কমিটির নির্দিষ্ট পোষাক বা ব্যান্ড দেয়া যেতে পারে, যাতে করে তাদেরকে সহজে চেনা যায়। একটি ‘ভিজিল্যান্স টীম’ থাকতে পারে, যারা ‘র‍্যান্ডম’ ‘সাব-কমিটি’র কার্যক্রম পরিদর্শনে যাবে এবং এর উপর ঢাকার সেন্ট্রাল কমিটিকে সময়ে সময়ে অগ্রগতির রিপোর্ট প্রদান করবে।

>> অরিজিন্যাল ফরমালিন কিট থাকতে হবে সাব-কমিটিসহ প্রতিটি ভিজিল্যান্স টীমের কাছে। এই জিনিসটিই খুব গুরুত্বপুর্ণ। ফরমালিন বা কার্বাইড টেস্টিং কিট আসল না নকল সেটা বোঝার যথাযথ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারা যাচাই-বাছাই হয়ে একটি আদর্শ কিট বাজারে আসতে হবে।

>> অবৈধ ফরমালিন বা কার্বাইড এর মূল উৎস বন্ধ করতে হবে। আর বৈধ ভাবে এই কেমিক্যাল যাদের মাধ্যমে ইম্পোর্ট হয়ে দেশে প্রবেশ করে, তাদের নির্দিষ্ট তালিকা সেন্ট্রাল কমিটর কাছে থাকবে এবং ইম্পোর্টাররা সেগুলো কোথায় কোথায় সরবরাহ করে থাকেন তার যথাযথ তালিকা এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সেন্ট্রাল কমিটিকে দেখাতে বাধ্য থাকবেন।

>>  আমবাগানগুলোতে কাজ করা সাব-কমিটি সেন্ট্রাল কমিটির কাছে সেই সব ট্রাকের নাম্বার প্রদান করবে যাতে কার্বাইড মিশানো ফল রয়েছে। কারণ তাদের চোখের সামনে দিয়েই তো চালানগুলো বাক্সবন্দী হয়ে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে সরবরাহ হবে। আর সেন্ট্রাল ভলান্টিয়াররা সেই নির্দিষ্ট পরিবহনকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদেরকে সাথে নিয়েই টা করা হবে। আর আসল বিষাক্ত উপাদান পরীক্ষা করার কিট দ্বারা যদি মানদণ্ডে ফেল করে তবে সেন্ট্রাল কমিটির যে কেউ ওই বিষাক্ত ফলের মালিকের বিরুদ্ধে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে মামলা করবে।

>>অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট জিয়া আহসান তার কোনো এক লেখায় কাঁচা বাজারগুলোতে কমপক্ষে দুইটি ‘ফ্রিজার’ রাখার কথা উল্লেখ করেছেন। উন্নত রাষ্ট্রে এর বহু নজীর রয়েছে। এজন্য আমাদের দেশের কাঁচা বাজারগুলো এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে কমপক্ষে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। আর বাজারের সকল দোকান মালিকেরা নিজেরা মিলে এই ফ্রিজারের ব্যবস্থা করবে। তাহলে সব্জিতে ফরমালিন মেশানোর আর প্রয়োজন হবে না। আড়তগুলোতেও অপেক্ষাকৃত বড় ফ্রিজারের ব্যবস্থা করতে পারলে ফরমালিন প্রয়োগের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। আর আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দ্বারাও পণ্য পরিবহনে সময় সাশ্রয় করাটাও একটা বড় ফ্যাক্টর। পথে ঘন্টার পর ঘন্টা হিউজ ট্রাফিক জ্যামের কারনে সব্জি নষ্ট হবার ভয়েও সরবরাহকারীরা ফরমালিন মেশাতে বাধ্য হয় ।

উপরের যে সমস্ত পয়েন্টে আলোচনা করলাম, সেখানে আসল হলো আমাদের মানষিকতার পরিবর্তন। আর একে অন্যকে নিঃস্বার্থ সহায়তা করা। বাগান মালিক সাব-কমিটিকে সাহায্য না করলে, প্রশাসন এদের পক্ষে না থাকলে কিংবা সেন্ট্রাল কমিটির সদস্যরা নৈতিকতার মানদণ্ডে উৎরাতে না পারলে সব কিছু ‘ এ বিগ জিরো’  ছাড়া আর কিছুই হবে না। দুর্নীতি আমাদের সমাজ জীবনে এতোটা প্রভাব বিস্তার করেছে যে, শংকিত হতেই হয়। কারণ আমরা অনেক দেখেছি, “যে যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ”।

আমাদের দেশে প্রতিটি উপজেলায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি রয়েছে যেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে এই কমিটি ভোক্তাদের অধিকার যাতে সংরক্ষিত হয়, সেজন্য কাজ করেন। এছাড়াও এধরণের অনুমোদনপ্রাপ্ত সমমনা বিভিন্ন সংগঠন আছে এদেশে। কিন্তু তারা কতটুকু কি করছেন? এমনও শোনা গেছে, ভোক্তা অধিকারের নামে গড়ে ওঠা এসব সংগঠনের কাজ হলো নজরদারির নামে শ্রেফ চাঁদাবাজি!! ঢালাওভাবে সবগুলোর প্রতি অভিযোগের তীর না তুললেও, এদের অধিকাংশই বর্তমানে এই কাজে নিয়োজিত। এজন্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে কিছু একটা তো আমাদেরকে করতেই হবে। আমি আমার আলোচনায় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা এসেছে সেভাবে কিছু   দিকনির্দেশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এবার অন্যরা একটু ভাবুন। নিজেদের সন্তানদের মুখে কি তুলে দিচ্ছেন সেটা আপনারা সজ্ঞানে জেনে দিচ্ছেন কি?

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment