নবাবগঞ্জের ৪শ’ বছরের ঐতিহ্য বান্দুরা ভাঙা মসজিদ

বিপ্লব ঘোষ, দোহার-নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি.

ঢাকার নবাবগঞ্জে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে প্রায় ৪শ’ বছরের পুরানো বান্দুরা শাহী (ভাঙা) মসজিদ। সম্প্রতি মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ১৬৫ ফুট উচ্চতার একটি মিনার। মিনারটি ঢাকা দক্ষিণের সবচেয়ে বড় মিনার বলে জানা যায়। এলাকাবাসী জানান, নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে নতুন বান্দুরা শাহী মসজিদ তথা ভাঙ্গা মসজিদের অবস্থান। প্রায় ৫০ শতাংশ জমির উপর তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি অবস্থিত। এর মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ জমির উপর রয়েছে মূল ভবনটি। প্রতিদিনই দূর দূরান্ত থেকে মসজিদটিতে মুসল্লিরা আসেন এবাদত করতে। তবে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে নবাবগঞ্জসহ এর পার্শ্ববর্তী দোহার, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ আশেপাশের উপজেলার কয়েক হাজার নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে মসজিদটিতে। মসজিদে মহিলাদের নামাজের জন্য রয়েছে আলাদা সু-ব্যবস্থা। স্থানীয়রা জানান, ভাঙ্গা মসজিদটি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কল্পকাহিনী প্রচার করা হয়েছে।

অনেকে বিশ্বাস করেন ভাঙ্গা মসজিদটি গায়েবী মসজিদ। এর মূল ভবনটি মাটির নিচ থেকে উঠেছে। এমনকি এই মসজিদটি নিয়ে অনেকে আবার অপপ্রচার চালায়। তবে আগতদের বিশ্বাস ভাঙ্গা মসজিদের কিছু মানত করলে আল্লাহর রহমতে সেই আশা পূরণ হয়। সেই বিশ্বাসেই মসজিদে মুসল্লিদের আগমনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তবে স্থানীয়দের ধারণা, তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি স¤্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত। এলাকার কয়েকজন বয়োজেষ্ঠ্য লোক জানান, ১৬১০ সালে ভারত বর্ষের মোঘল বংশের দিল্লীর স¤্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদার ছিলেন ইসলাম খান চিশতি। সুবেদার ইসলাম খান চিশতি বিভিন্ন প্রয়োজনে দিল্লী হইতে যমুনা নদী দিয়ে নৌবিহার নিয়ে পাবনা জেলা হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে মানিকগঞ্জ হয়ে ইছামতি নদী দিয়ে ঢাকায় (জাহাঙ্গীর নগর) যাতায়াত করতেন। সেই সময় রাত যাপন ও ইবাদত করার জন্য আনুমানিক ১৬১৫ সালে নদীর পাশেই মসজিদটি নির্মাণ করেন তিনি। কালের পরিবর্তনে ইছামতি নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে উত্তর দিকে চলে যায়। তখন মসজিদের পাশ্ববর্তী কোনো বসতি ছিলো না। পুরো এলাকাই ছিলো বনাঞ্চল। ১৮৮০ সনে হিন্দু জমিদারেরা এই সমস্ত বনাঞ্চল পত্তন নেন। তখন এখানে হিন্দুরা বসতি স্থাপন করার জন্য বনাঞ্চল কাটা আরম্ভ করেন। বন কাটার সময় এখানে একটা মসজিদ ঘর দেখতে পান। যার উপরের কিছু অংশ ভাঙ্গা। তখন থেকেই এই মসজিদের নাম হয় ভাঙ্গা মসজিদ বা গায়েবী মসজিদ। সেই সময় সেখানে মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন সরঞ্জমাদি পাওয়া যায়। তবে সময়ের সাথে সাথে সেগুলো হারিয়ে গেছে। এরপর মসজিদের দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় আলফু ফকির, দুদু মীর, আবেদালী মীর, গোপাল মাদবর, মৈজদ্দিন সিকদার, গহের আলী খন্দকারসহ স্থানীয়রা। সেই সময় আবু মোল্লাকে মসজিদের মাতুয়াল্লী বা সেবায়েত নিযুক্ত করা হয়। সিএস রেকর্ডে মসজিদের পক্ষে তার নামই রয়েছে। ১৯৪৫ সালে স্থানীয় আবেদ আলী নিজ অর্থায়নে কিছু অংশ সংস্কার করেন। তখন মসজিদের সেবায়াত হিসেবে দুখাই বেপারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬০ সালে নতুন বান্দুরা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে আসেন আবজাল হোসেন নামে এক ধর্মপ্রাণ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি গ্রামবাসীকে নিয়ে ভাঙ্গা মসজিদটির কিছু মেরামত এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে কমিটির গঠন করেন। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয় ডা. আলমাছ উদ্দিনকে। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মকবুল বেপারীকে ও কদম আলীকে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

উক্ত কমিটি প্রায় ২০ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮০ সালে স্থানীয় আমজাদ হোসেন মাদবর গ্রামবাসীকে নিয়ে মসজিদের নতুন কমিটি গঠন করে দায়িত্ব বুঝে নেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। তখনও মূল ভবনের সংস্কার করলেও তার অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। পরবর্তীতে আমজাদ হোসেন মাদবরের ছোট ছেলে কুয়েত প্রবাসী নজরুল ইসলামের প্রচেষ্টায় বিদেশের অর্থায়নে মসজিদটির সংলগ্ন আরেকটি ভবন তৈরি করা হয়। ২০০১ সালে মীর সফিউদ্দিন ও জনাব আলী সিকদারকে উপদেষ্টা হিসেবে রেখে খন্দকার ফুরহাদ হোসেনকে সভাপতি, মতিয়ার রহমানকে সাধারণ সম্পাদক ও ফজলুর রহমানকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে নতুন কমিটি গঠন করেন। নতুন কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর মসজিদ প্রাঙ্গনে একটি মিনার নির্মাণের পদক্ষেপ নেন। প্রাথমিকভাবে ৬০ ফুট চালাইয়ের উপর ১৪টি পিলার নির্মাণ করা হয়। ঐ সময়ই তাদের ব্যয় হয়েছিলো প্রায় ৭ লক্ষ টাকা। কিছুদিন কাজ করার পর মিস্ত্রী ও আনুসাঙ্গিক অসুবিধার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১১ সালের ৪ মার্চ পূর্ণরায় মিনারের কাজ আরম্ভ হয়।

১৬৫ ফুট উচ্চতা মিনারটি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমান মসজিদ কমিটির সদস্যরা জানান, মসজিদ সংস্কারে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। মিনারটি নির্মাণে সরকারি ভাবে কোনো সাহায্য নেয়া হয়নি। মসজিদে আগত মুসল্লিদের অনুদানেই সম্পূর্ণ মিনারটি নির্মিত হয়েছে। এ ব্যাপারে মসজিদের প্রায় ৩০ বছরের কোষাধ্যক্ষ মো. ফজলুর রহমান বলেন, মসজিদে আগত মুসল্লিদের দানে মাসে প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় হয়। সেই টাকা দিয়েই কোটি টাকা ব্যয়ে মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতি শুক্রবার নামাজ শেষে উপস্থিত সকলকে অবহিত করা হয়। মসজিদের ইমাম মুফতি মতিয়ার রহমান বলেন, মানুষ আল্লাহ উপর বিশ্বাস করেই ভাঙ্গা মসজিদে আসে এবাদত করতে। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার কয়েক হাজার মানুষের আগমন ঘটে এই মসজিদে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি তাদের সহযোগিতা করতে।

আপনি আরও পড়তে পারেন