কর্পোরেট বৈশাখ

বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে বৈশাখের আসল রূপ। মানুষের মনে উৎসবের আমেজ আছে, পাড়ায় পাড়ায়ও সেই উৎসব চলছে জোরেশোরে। কিন্তু তারপরও বড় পরিসরে আয়োজন হওয়া অনুষ্ঠানগুলোর বেশকিছুকে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

বছরের প্রথম দিন প্রথম প্রহরেও ছিল প্রখর তাপ। অথচ রাস্তায় মানুষের ঢল। সকাল ৭টার রোদে ভিজে যাওয়া শরীরে ক্লান্তি নেই কিন্তু কে যেন হাত পাখা বাড়িয়ে দিলো পাশে। হাতে নিতে তাতে লেখা একটি ব্যাংকের নাম। রমনার দিকে কিছুদুর হেঁটে এগিয়ে যেতে আবারও কোন হাত ধরিয়ে দিলো আরেকটি পাখা- তাতে আরেক ব্যংকের বিজ্ঞাপন। ভ্রু কুঁচকে কিছুটা বিরক্ত মানুষ তবু দ্বিতীয় পাখাটিও নেন। মুখে তিতা হাসি ঝুলিয়ে তবু বলেন শুভ নববর্ষ।

হেঁটে রমনা থেকে টিএসসির পথে যেতে গাছে গাছে পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপনী বহর এবং যে কোনও আয়োজনে বর্ষবরণের আগে বিজ্ঞাপনদাতার ট্যাগ দিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, তা দেখে মনে হতে পারে কেবল বর্ষবরণ বলে কিছু নেই। কেউ করে দিলে আমরা পাতে পাব কিছু।

কয়েকজন বন্ধু রমনায় বসে সপরিবারে ছায়ানটের বিশুদ্ধ পরিবেশনা শুনছেন আর আড্ডা দিচ্ছেন। আসলে বাংলা নববর্ষ লেখা সকাল থেকে নাকি রাত ১২টা থেকে শুরু করা উচিত। যদি সকাল থেকেই হবে তবে বার্জারের সহযোগিতায় এশিয়াটিক রাতের বেলা উদযাপন শুরু করলো কেন, সে প্রশ্ন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকতায় এশিয়াটিক ইএক্সপি আয়োজন করেছে ‘বার্জার রঙে রঙিন বৈশাখ’ উৎসব ছিল চৈত্রসংক্রান্তির রাতে। এই বড় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই উদযাপন শুরু হয়ে গেছে। ওই আড্ডায় ছিলেন বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত আজিজুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলা ক্যালেন্ডারের দিন যে সকাল থেকে শুরু হয়, এসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কখন যে তা হারিয়ে যায় কে জানে।

বৈশাখে কর্পোরেট বিজ্ঞাপনছায়ানটের পর সবচেয় বড় পরিসরে উদযাপনের আয়োজন ছিলো বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৫টা থেকে। ৬টায় গিয়ে দেখা গেলো চারপাশে বিজ্ঞাপনী ফেস্টুন আর সেই বিজ্ঞাপনী হাত পাখা। এখানে চ্যানেল আই আর সুরের ধারার আয়োজনে ‘সানসিল্ক বর্ষবরণ’ আয়োজন করা হয়েছে। মঞ্চে গান চলছে। সেখান থেকে খানিক দূরে খাওয়া দাওয়ার স্টল, একটা দুটো বাঙালিয়ানার নিদর্শন বিক্রির দোকানও আছে। খাবার দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেলো, খাওয়ার মেনুতে চিকেন ফ্রাই, স্যান্ডুইচ, বার্গার, পেস্ট্রিসহ ‘বাঙালি’ খাবার।

এখানে মূলত চ্যানেল আই ঘরানা ও মিরপুর মোহাম্মদপুরবাসীরা বেশি উপস্থিত হয়ে থাকেন। গান শুনতে শুনতে খাবারের দোকানের দিকে যাওয়ার পথে আলাপ হয় এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, যেভাবে ‘সানসিল্ক বর্ষবরণ’ বলা হচ্ছে- আমরা মরে গেলে আমাদের সন্তানের সন্তানেরা ভাববে ১৪ এপ্রিল বছরের নতুন দিনকে ‘সানসিল্ক বর্ষবরণ’ বলে। অন্তত টাইটেল বিক্রি না করলে আপনাদের কি হয় বুঝি না। সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, আমারটা বয়ে নিতেইতো আমি ভোর বেলা পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি। কিন্তু এসবতো মনটা খারাপ করে দেয়।

বিভিন্ন এয়ারলাইন্স যেমন বৈশাখের বিশেষ ছাড় অফার দিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে অনলাইনে অফলানে, তেমনই খাবার দোকানে পিজা থেকে শুরু করে বিদেশি নানা খাবারেই আজকের দিনেও বিশেষ আয়োজনের তোড়জোর।

কর্পোরেট দুনিয়ায় এমন প্রতিষ্ঠানও আছে যারা নববর্ষ পালন করছেন ঠিকই কিন্তু কোনও বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়। তারা পালন করছেন তাদেরই যারা ক্রেতা আছেন, বন্ধু আছেন তাদের ঘিরে, নিজেদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়ে।

একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা মুনিরা হাসান বলেন, এখনকার সময়ে একটি প্রতিষ্ঠান চাইবেই তার বিজ্ঞাপনটা পৌঁছাতে, পাশাপাশি সেটা কতোটা সুশ্রী করে তোলা যায় সে দায়িত্ব কিছু দাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই নির্ধারণ করতে হবে। ভাল কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজক যদি কনফিডেন্ট থাকে নিজের আয়োজন নিয়ে, তাহলে বিজ্ঞাপনদাতাকে কনভিন্স করা তার পক্ষে সম্ভব।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment