মানিকগঞ্জের ব্র্যান্ড স্বীকৃত পেল ঝিটকার হাজারী গুড়

মানিকগঞ্জে ব্র্যান্ডিং স্বীকৃত পেল ঝিটকার হাজারী গুড়

 

 আমরা জানি পাঠ্য পুস্তুকে খেঁজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত ফরিদপুর ও যশোর জেলা। আজও ফরিদপুর ও যশোর খেঁজুর গাছের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু মানসম্মত ও ঐতিহ্যের দিকে নজর দিলে মানিকগঞ্জ জেলাই একমাত্র খেঁজুরের গুড়ের মানের দিক থেকে সবার ওপরে। এর মধ্যে ঝিটকার হাজারী গুড় জগৎ বিখ্যাত হিসেবে সুপরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

মানিকগঞ্জে ব্র্যান্ডিং স্বীকৃত পেল ঝিটকার হাজারী গুড়

শুধু তাই নয়, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে এই হাজারী গুড়কে মানিকগঞ্জের ব্র্যান্ডিং স্বীকৃত প্রদান করা হয়। হাজারী গুড়ের রহস্য খুঁজতেই বেরিয়ে আসে হাজারী গুড়ের প্রকৃত ঐতিহ্য ও ইতিহাসের। ঝিটকার হাজারী বাড়ি নামে পরিচিত বাল্লা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম হাজারীর বরাত দিয়ে জানতে পারলাম হাজারী গুড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তিনি জানান, একটি নাম, একটি পরিচিতি, একটি ইতিহাস, একটি ঐতিহ্য “মোঃ হাজারী”। আজ থেকে প্রায় ৩০০ (তিনশত) বছর পূর্বে বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের ঝিটকা শিকদার পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন মোঃ হাজারী নামে এক ঐতিহাসিক ব্যক্তি। যার পিতার নাম ছিল জাকির মাহামুদ। জাকির মাহামুদ ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান কৃষক। তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি শীতকালে খেঁজুর গাছের রস আহরণ করে সু-স্বাদু খেঁজুরের গুড় উৎপাদন করতেন। তার একমাত্র পুত্র সন্তান মোঃ হাজারীর জন্ম লাভের পর থেকেই জাকির মাহামুদের সংসারের আয় দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। মোঃ হাজারী স্থানীয় পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করে তার পিতার সাথেই কৃষি কাজে মনোনিবেশ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান, ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপ্রাণ, পরহেজগার এবং নানা বিধ সৃষ্টিশীল কাজে অত্যন্ত পারদর্শী। বাবার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে খেঁজুরের গুড় তৈরি করার পদ্ধতিটি তিনি ভালোভাবেই রপ্ত করেন। “পূর্বের ইতিহাস থেকে আরও জানায় যায়, তরুণ বয়সে কোনো একদিন মোঃ হাজারী তার বাড়ী থেকে একটু দূরে খেঁজুরের বাগানের ভিটায় সন্ধ্যার প্রাক্কালে খেঁজুর গাছ কেটে রস আহরণের জন্য গাছে হাঁড়ি বেঁধে সবে নিচে নেমে এসেছেন; এমন সময় খেঁজুর বাগানের পাশ দিয়ে মেঠো পথ ধরে এক দরবেশ এসে তার পানির পিপাসা নিবারণের জন্য মোঃ হাজারীর নিকট দাবী জানালেন। আশেপাশে পানীয় জলের কোনো সন্ধান না করতে পেরে মোঃ হাজারী যখন দরবেশ সাহেবকে জানালেন; দরবেশ সাহেব তখন বললেন তুমি তাহলে আমাকে খেঁজুরের রস খাওয়াও তাতেই আমার তেষ্টা মিটবে। অতঃপর মোঃ হাজারী বিনয়ের সাথে বললেন, আমি এই মাত্র গাছে হাড়ি দিলাম রস হবে কোথা থেকে? তারপরেও দরবেশের আবদার রক্ষায় তিনি গাছে উঠে হাড়ির ভেতর উঁকি দিতেই বিস্মিত হলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ ভাল পরিমাণ রস হাড়িতে জমে আছে। রস পেড়ে তিনি দরবেশ সাহেবকে পান করালেন। পিপাসিত দরবেশ বাবা রস পান করে তৃপ্ত হয়ে মোঃ হাজারীকে প্রাণ ভরে দোয়া করলেন এবং ভাল গুড় বানানোর কিছু উন্নত পদ্ধতির পরামর্শ দিলেন। তিনি আরও নির্দেশ দিলেন তোমার “হাজারী ” নাম টুকু তুমি সিল আকারে গুড়ে ব্যবহার করবে। মোঃ হাজারী এরপর থেকে উক্ত দরবেশ সাহেবের পরামর্শ আনুসরণ করে আরও মনোযোগ সহকারে গুড় উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করলেন এতে করে হাজারী গুড়ের সু-খ্যাতি দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এর সু-খ্যাতি এতই বিস্তার লাভ করল যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের উপঢৌকন হিসাবে এর ব্যবহার প্রচলিত হয়ে গেল। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামলে ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেদের নিকটও এই “হাজারী গুড়” উপঢৌকন হিসাবে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এই উপহার উপঢৌকনের ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। মোঃ হাজারী কর্তৃক উদ্ভাবিত এই খেঁজুরের গুড়ের বিশেষত্ব হলো এর আকর্ষণীয় রং, সু-ঘ্রাণ এবং অতুলনীয় স্বাদ। সাধারণ খেঁজুরের গুড়ের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রং, ঘ্রাণ ও স্বাদের এই হাজারী গুড় শুধুমাত্র হাজারী পরিবারকেই বিখ্যাত করেনি বৃহত্তর ঝিটকা তথা মানিকগঞ্জ জেলাকে করেছে সমধিক প্রসিদ্ধ ও সমৃদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে কিছু অসাধু গুড় ব্যবসায়ীরা এই খেঁজুরের সাথে চিনি মিশ্রিত করে এর স্বাদ, গন্ধ ও ঐতিহ্যকে করেছে মলিন। শুধু হাজারী গুড়ই নয়, সাধারণ গুড়ও এখন চিনি ছাড়া কল্পনা করা যায় না। পাঁচ কেজি গুড়ে কমপক্ষে তিন কেজি চিনি মিশ্রিত হয়। এখন কেবল মাত্র রসের ছিটে ফোঁটা ঘ্রাণটাই পাওয়া যায়। গড়ের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চিনি। ফলে এখন আর বিশ বছর আগের সেই গুড় বাজারে মেলে না। আগের দিন দেখা যেত শীতের শুরুতে প্রতিটি বাড়িতেই খেঁজুরের রস দিয়ে গুড় বানানোর ধুম পড়ে যেত। এখন কালের বিবর্তনে খেঁজুর গাছও বিলিন হয়ে গেছে। আগে গ্রামের মেঠো পথ ধরে সারি সারি খেজুর গাছ দেখা যেত এখন আর তা পরিলক্ষিত হয় না। ফলে খেঁজুরের গুড়ের এখন একমাত্র উপাদান চিনি। চিনি বিহীন এক কেজি লাল গুড়ের দাম প্রায় ৬০০-৭০০টাকা। আর চিনি মিশ্রিত গুড় বাজারে বিক্রি হয় ১২০-১৫০ টাকা। খাঁটি এক কেজি হাজারী গুড়ের দাম ১২০০-১৪০০ টাকা। আর চিনি মিশ্রিত এককেজি হাজারী গুড়ের দাম ৬০০-৮০০টাকা। খেঁজুরের গাছের চাষ কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলে গুড়ের দাম বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ। সাথে রয়েছে গুড় বানানোর প্রধান উপকরণ লাকড়ী। তাই গাছীরা তাদের পারিশ্রমিক মেটানোর তাগিয়ে তারা এমন ভেজাল গুড় বানাতে উদ্ভুদ্ধ হয়। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে ঝিটকার ঐহিত্য হাজারী গুড়ের সুনামও। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ঝটিকা অভিযান চালালে কিছু দিন তা লোপ পেতে থাকে। দু’চারদিন অতিবাহিত হলেই আবার ভেজাল গুড়ে সয়লাব হয়ে পড়ে হরিরামপুরের বিভিন্ন হাট বাজার। হাজারী গুড় নিয়ে কথা বলেন হাজারী পরিবারের সপ্তম প্রজন্মের বংশধর বাল্লা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুল ইসলাম হাজারী শামীম। তিনি জানান, হাজারী গুড়ের গুণগত মান বজায় রাখতে যে সকল পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। মূলত আমরা এই গুড় তৈরি থেকে অনেক দূরে সরে আসায় এরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে এখন বন্ধ করে দেওয়াও সম্ভব না। যারা এই হাজারী গুড়ের সিল ব্যবহার করছে তারা সঠিকভাবে হাজারী গুড় তৈরি করছে না। মূলত যারা এখন হাজারী গুড় তৈরি কওে বাজারজাত করছে তাদেরকেই এই গুড়ের গুণগত মান বজায় রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবুল বাশার সবুজ বলেন, মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নেতৃত্বে এই হাজারী গুড়কে মানিকগঞ্জের ব্র্যান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এটা অবশ্যই আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের। তবে এই হাজারী গুড়কে শতভাগ ভেজাল মুক্ত করা খুব দূঢ়হ ব্যাপার। তারপরেও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং যাব। যাতে করে আমাদের এই ঐতিহ্য অক্ষ্মণœ রাখা যায়। এছাড়াও ভেজাল গুড় বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা আরো কঠোর হওয়া দরকার বলে মনে করেন অত্র এলাকার সুশীল সমাজ। এতেই রক্ষা হতে প্রায় ৩০০(তিনশত) বছর পূর্বে একজন সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের এক অনন্য উপাদান। টিকে থাকবে ইতিহাসের এক উজ্জল নক্ষত্র হিসাবে মানিকগঞ্জ জেলার ঝিটকার হাজরী গুড়। বেঁচে থাকবেন মোঃ হাজারী তার অনন্য সৃষ্টির মাধ্যমে অনন্তকাল ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment