ফেনী-৩ (দাগনভূঞা ও সোনাগাজী) আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে এবার মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে দল ও মহাজোটের মধ্যে চলছে নানামুখী দ্বন্দ্ব-বিরোধ। অন্যদিকে, বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা কম। মূলত দু’জন কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যেই প্রার্থিতার লড়াই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে এ দলে। এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণায় উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে নির্বাচনী মাঠ। একই সঙ্গে প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও মাথাচাড়া দিচ্ছে। একদিকে মহাজোটকে এবং অন্যদিকে মনোনয়নপ্রত্যাশী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কেন্দ্রীয় ও প্রভাবশালী নেতাকে সামাল দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে এবার মনোনয়ন দেওয়া বেশ কঠিন হতে পারে। জেলা বিএনপিতে সাবেক দুই সভাপতি মরহুম মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার ও মোশাররফ হোসেনের মৃত্যুর পরও অতীতের দলীয় বিভাজনের জের টানতে হচ্ছে দলের সবাইকে। ফলে অনেক স্থানীয় নেতাকর্মীই কিছুটা নিষ্ফ্ক্রিয় অথবা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছেন।
এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন- বর্তমান এমপি ও জেদ্দা আওয়ামী লীগ সভাপতি রহিম উল্লাহ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী, যুবলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য আবুল বাশার, জেলা যুবলীগ সভাপতি ও দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সহসম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন, কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও এনবিআর গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আক্রাম হোসেন হুমায়ুন, সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান জেড এম কামরুল আনাম, কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা শাহজাহান সাজু।
বিএনপি থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা হলেন- দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, কেন্দ্রীয় নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাসির উদ্দিন আহমেদ, দাগনভূঞা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আকবর হোসেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুল লতিফ জনি, ওয়ান ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাঈদ হোসেন চৌধুরী, কেন্দ্রীয় মহিলা দলনেত্রী অ্যাডভোকেট সাহানা আক্তার শানু।
গত নির্বাচনে ফেনী-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন জেদ্দা আওয়ামী লীগ সভাপতি রহিম উল্লাহ। নির্বাচনের পর থেকে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয়। দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে খুনের ঘটনাও ঘটে। এমপি রহিম উল্লাহ দাবি করেন, নিজাম হাজারী ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যার সঙ্গে জড়িত। দলীয় প্রধানের কাছেও এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন বলে জানান তিনি। অবশ্য নিজাম হাজারীর সমর্থক সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুল আনাম বলেন, এ অভিযোগ সঠিক নয়। এমপি রহিম উল্লাহই এলাকার উন্নয়নের জন্য বড় বাধা।
দাগনভূঞায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়েছেন। কয়েক দিন আগে সম্ভাব্য প্রার্থী জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটনের এক সমর্থককে প্রকাশ্যে মারধর করে আরেক প্রার্থীর সমর্থকরা। সাবেক আওয়ামী লীগের এমপি প্রার্থী ও এবারের সম্ভাব্য প্রার্থী আবুল বাশারের সভায় এক নেতা যুবলীগ সভাপতি দিদারুল কবির রতনকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে সভাতেই উত্তেজনা দেখা দেয়। কয়েক দিন আগেও বাশারের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোনয়নপ্রত্যাশীর কর্মীরা।
আগামী নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থীকে এ আসনটি ছেড়ে দেওয়া হবে কি-না, এখনও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটপ্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির রিন্টু আনোয়ারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী রহিম উল্লাহকে সমর্থন করে এমপি নির্বাচিত করেন। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা দাবি করেন, আগামী নির্বাচনে মহাজোটকে এ আসন ছেড়ে দেওয়া হবে না। হাজি রহিম উল্লাহ এ ব্যাপারে জানান, নিজের প্রচেষ্টায় এমপি হয়ে তিনি শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করেছেন। আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হবেন বলে আশা করেন তিনি।
এ আসন থেকে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনের ক্ষমতাধর সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর নাম শোনা গেলেও এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার কয়েকজন সমর্থক জানান, দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তিনিই হবেন আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী।
গত নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রচার ও প্রকাশনা উপদেষ্টা রিন্টু আনোয়ার আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হচ্ছেন বলে নিশ্চিত করেছেন । তিনি জানান, দল তাকে এরই মধ্যে মনোনয়ন দিয়েছে। আর মহাজোট অটুট থাকলে এবারও তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। জোট থেকে মনোনয়ন না পেলে তিনি তাদের লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সহসম্পাদক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন। তিনি জানান, আগামী নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। এলাকায় তার ক্লিন ইমেজ রয়েছে বলে জানান সমর্থকরা।
কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী গত এক বছর সোনাগাজী ও দাগনভূঞা এলাকায় প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি জানান, মনোনয়ন চাইবেন, তবে মনোনয়ন না পেলেও দলের কাজ করে যাবেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবুল বাশার এবারও মনোনয়ন পাওয়ার আশা করছেন। তিনি জানান, ২০১৪ সালে মনোনয়ন পেয়েও মহাজোটের স্বার্থে জাতীয় পার্টিকে আসন ছেড়ে দেওয়ায় নির্বাচন থেকে সরে যান তিনি। তবে এবার জাপাকে ছাড় দেওয়া হবে না। এবারও দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন চৌধুরী এলাকায় নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ভোটের আগাম প্রচারণা শুরু করেছেন। তিনি বলেন, অনেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে যিনি জয়ী হতে পারবেন, দল তাকেই মনোনয়ন দেবে। তিনিও মনোনয়ন চাইবেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আক্রাম হোসেন হুমায়ুন জানান, দলের দুর্দিনে কর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে ছিলেন। দল নিশ্চয়ই বিমুখ করবে না। সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান জেড এম কামরুল আনাম বলেন, উড়াল পাখিদের এবার এ আসনে সুযোগ হবে না। জেলা যুবলীগ সভাপতি দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতনও মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা শাহজাহান সাজু বলেছেন, ফেনীতে অবস্থান করে তৃণমূলে কাজ করছেন তিনি।
এদিকে, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিএনপিতে তেমন তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জেলার দুই সাবেক সভাপতি সাঈদ এস্কান্দার ও মোশাররফ হোসেনের মৃত্যুর পরও রয়ে গেছে বিভক্তি। তাই সম্মেলনে মোশাররফ গ্রুপের নেতাকর্মীরা ঠাঁই পাননি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটিতে। মোশাররফ হোসেনের সমর্থক দাগনভূঞা বিএনপির সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বর্তমানে রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয়। সোনাগাজী বিএনপির সাবেক স্থানীয় নেতারাও মাঠে অনুপস্থিত। স্থানীয় বিশ্নেষকদের মতে, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন ও ভোট গ্রহণে এই বিভক্তির প্রভাব পড়বে।
স্থানীয় নেতারা জানান, বর্তমানে ফেনী বিএনপির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন মূলত দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। অন্য নেতারা যত ঘোরাফেরাই করুন না কেন, মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব থাকবে তার। আবার মিন্টুকে ঢাকায় নোয়াখালী অধিবাসী অধ্যুষিত কোনো আসন থেকেও মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তা করতে পারে বিএনপি হাইকমান্ড।
এ বিষয়ে আবদুল আউয়াল মিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবেন তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কি-না। দল চাইলে নিজের জন্মস্থান থেকেও নির্বাচন করতে পারেন তিনি। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, মিন্টু ফেনী থেকে নির্বাচন না করলে তার ছোট ভাই দাগনভূঞা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আকবর হোসেন মনোনয়নের চেষ্টা করতে পারেন। আকবর হোসেন জানান, তিনিও মনোনয়ন চাইবেন। পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই।
এ আসনে আরেক শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির সাবেক সহদপ্তর সম্পাদক ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুল লতিফ জনি। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক এই ছাত্রদল নেতা। আবদুল লতিফ জনি জানান, এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সব আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে ছিলেন তিনি। বর্তমানে মামলায় জর্জরিত বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশেও রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।
ওয়ান ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাঈদ হোসেন চৌধুরীও বিএনপিদলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানা গেছে। বিএনপি হাইকমান্ড মিন্টু বা জনির বিকল্প হিসেবে বিশিষ্ট এ ব্যবসায়ীকে চিন্তা করতে পারে। এদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাসির উদ্দিন আহমেদও এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে তার নিকটজনরা জানান। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরও রয়েছেন কেন্দ্রীয় মহিলা দলনেত্রী অ্যাডভোকেট সাহানা আক্তার শানু। তিনি বলেন, দলীয় মনোনয়ন তিনিও চাইবেন। নেত্রী তা বিবেচনা করবেন বলে আশা করেন তিনি।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলে জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে শিবিরের সাবেক সভাপতি ডা. ফখরুদ্দিন মানিককে জামায়াত মনোনয়ন দিতে পারে। এ ছাড়া জেএসডির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এ আসন থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। শহীদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে তিনি নির্বাচন করবেন। জোট তাকেই মনোনয়ন দেবে বলে দৃঢ় আশা তার।