ইটভাটায় ফসলি জমি বিলুপ্ত

ইটভাটায় ফসলি জমি বিলুপ্ত

নড়াইলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফসলি জমি দখল করে গড়ে উঠছে ইট ভাটা। জেলায় অর্ধ শতাধিক ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে পুড়ছে কাঠ। এতে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে এবং শত শত হেক্টর কৃষি জমি হুমকির মুখে পড়ছে। এদিকে ভাটায় কাচা মাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর মাটি।
ইটভাটায় ফসলি জমি বিলুপ্তজানা গেছে, প্রতি মৌশুমে অন্তত সাড়ে ৩শ একর ফসলি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি গিলছে এসব ইট ভাটা । এক্ষেত্রে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

সরকারি হিসাব অনুযায়ী জেলায় মোট ৬০টি ইট ভাটা রয়েছে। তবে বিভিন্ন সূত্র মতে, জেলায় মোট ইট ভাটার সংখ্যা ৭৪টি, যার মধ্যে ৬০টি ভাটাতে রয়েছে ব্যারেল চিমনি যা সম্পূর্ণ অবৈধ। অনুমোদনের তোয়াক্কাই করেনা অধিকাংশ ইটভাটা। লোকালয়ে অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটায় বেপরোয়াভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, কৃষিজমির উপরি ভাগের উর্বর মাটি ব্যবহার হচ্ছে ইটের কাঁচামাল হিসেবে। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে গাছপালা, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে কৃষিজমি। প্রশাসনের নাকের ডগায় নির্বিবাদে চলা পরিবেশঘাতী এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণের দৃশ্য চোখে পড়ে না।

 

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আকার ভেদে একটি ইটভাটা গড়ে তুলতে কমপক্ষে ৫ একর (৫শ শতক) জমির প্রয়োজন হয়। কোন কোন ইট ভাটা তৈরি করতে ৩০-৩৫ একর জমিও প্রয়োজন হয়। এক যুগ আগে জেলায় হাতে গোনা ১৮-২০ টি ভাটা ছিল। কিন্তু এখন তা বেড়ে প্রায় ৪ গুনে পৌঁছেছে। আর এসকল ইট ভাটা তৈরি করতে অন্তত ৪ শত একর ফসলি জমি ব্যবহৃত হয়েছে বলে কৃষকদের দাবি।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাটার ম্যানেজার জানান, সাধারণত মধ্যম সারীর একটি ভাটায় বছরে ৪০/৫০ লক্ষ ইট পোড়ানো হয়ে থাকে। আর প্রতি ৮ হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হয় ১হাজার ঘনফুট মাটি। যে মাটির যোগান দেওয়া হয় কৃষি জমি থেকে। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে ৭/৮ একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহৃত হয়। সে হিসাবে ৭৪টি ভাটাতে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে ৩শ একর জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহৃত হয়। ভাটার মালিকরা বলছেন, সময়মত কয়লা না পাওয়া এবং কয়লার মূল্য বেশি হওয়ায় বাধ্য হয়ে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে।

 

প্রতিদিন ইট পোড়ানোর জন্য গড়ে প্রতিটা (একটি) ভাটায় ৩৫-৪০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। তাহলে জেলার ৭৪টি ইটভাটায় প্রতিদিন ২ হাজার ৫শ মন কাঠ পোড়ে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক কাঠ ব্যবসায়ী জানান, ইট ভাটায় সাধারণত আমরা যে কাঠ দেয় সেগুলো বিভিন্ন গ্রাম থেকে কিনে ভাটায় পৌঁছে দেয়। গড়ে প্রতিটা গাছে ৪ থেকে ৫ মন কাঠ পাওয়া যায়। হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন ইট ভাটায় আম, জাম, রেন্ট্রি, কদম, জামরুল, কাঁঠাল, খেজুর, নারকেলসহ ৩শতাধিক ফলজ ও বনজ গাছ জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

সদর উপজেলার সীবানন্দপুর গ্রামের কৃষক মনিরুল ইসলাম বলেন, ভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষেতের পাশে ইটভাটা স্থাপন করায় আগের তুলনায় এখন জমিতে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। সরকার যদি এই ভাটা গুলো ফসলী জমির কাছ থেকে সরিয়ে না নেয় তাহলে আগামী কয়েক বছর পর হয়ত জমি থেকে আমরা কোন ফসল পাবনা।

 

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সমাজ কর্মী কাজী হাফিজুর রহমান জানান, প্রতিটি ভাটায় অনবরত কাঠবোঝাই যানবাহন প্রবেশ করে। ভাটাগুলোতে মজুদ রয়েছে হাজার হাজার মণ কাঠ। কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। কৃষিজমি এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ভাটায় স্বল্প উচ্চতার টিনের তৈরি চিমনি দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। এতে ফসলসহ পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রতি বছর এই সময় আসলে প্রশাসনের লোকজন কিছু কিছু ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করলেও তাতে কোন লাভ হচ্ছেনা। ইটাভাটার যে সব আইন রয়েছে সে আইন যথাযথ প্রয়োগ করে পরিবেশঘাতি এ সকল কর্মকাণ্ড অচিরেই বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক চিন্ময় রায় বলেন, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে সেই জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। ৪-৫ বছর সেই জমি থেকে ফসল উৎপাদন অনেক কমে যায়। ফসলি জমির আশেপাশে ইট ভাটা থাকলে কৃষকের ফসল উৎপাদন অনেক কমে যায়। ইতো মধ্যে জেলা প্রশাসককে বিষয়টি মৌখিক ভাবে জানানো হয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসনকে লিখিত ভাবে অনুরোধ জানাব যে সকল ইটভাটার মালিকেরা ফসলি জমির মাটি কেটে ইট ভাটার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবং ফসলি জমির পাশে যেন ইটভাটার অনুমতি না দেন সে ব্যাপারেও আমরা অনুরোধ জানাব।

 

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দীন জানান, নড়াইলে কিছু ইটভাটা মালিক কয়লা ব্যবহার না করে কাঠ পোড়াচ্ছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব ভাটায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি এবং জরিমানা করছি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment