শরীয়তপুর-২ প্রার্থী বদলের গুঞ্জন আ’লীগে বিএনপিতে প্রস্তুত একাধিক

শরীয়তপুর-২ প্রার্থী বদলের গুঞ্জন আ'লীগে বিএনপিতে প্রস্তুত একাধিক

শরীয়তপুর-২ (নড়িয়া ও সখিপুর) বরাবরই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এ আসনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এমপি নির্বাচিত হন নুরুল হক হাওলাদার। আওয়ামী লীগের এই নেতা ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন। এরপর উপনির্বাচনে জয় পান আওয়ামী লীগের ডা. আবুল কাসেম। বর্তমান এমপি কর্নেল (অব.) শওকত আলী এ আসনে ছয়বারের বিজয়ী। প্রথমবার ১৯৭৯ সালে; এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। মাঝখানে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির টি এম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপির ডা. কে এ জলিল এ আসন থেকে এমপি হন। সাবেক ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা কর্নেল (অব.) শওকত আলীর নড়িয়া-সখিপুরে এখনও শক্ত অবস্থান রয়েছে। তবে গুঞ্জন রয়েছে, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বদল করে নতুন মুখ আনার। এ ধরনের গুঞ্জন মূলত স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বের। এদিকে, শরীয়তপুর-২ আসনে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা সুসংহত না হলেও একাধিক প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেন্দ্রে লবিং করছেন। তবে মাঠ পর্যায়ে দলের কোনো কর্মকাণ্ড নেই।

 

শওকত আলী একসময় আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পরে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো চ্যালেঞ্জে পড়েন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ সিমন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান।

অন্তর্কোন্দলে এ আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এখনও নেতাকর্মীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হামলা-মামলার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। কর্নেল (অব.) শওকত আলী দীর্ঘদিন এমপি থাকায় তার নিজস্ব বলয় তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে গত উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল ব্যাপকতা পায়। ওই সব নির্বাচনে শওকত আলীর ‘বিতর্কিত’ ভূমিকা থাকায় নেতাকর্মীদের অনেকেই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে তার দুর্গে কিছুটা হলেও ফাটল ধরেছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। আবার বয়সের কারণেও তিনি কিছুটা অসুস্থ। এ অবস্থায় তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি-না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন দলের অনেক নেতাকর্মী। তবে শওকত আলী নিজে আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। সেইসঙ্গে বিকল্প হিসেবে তার ছেলে ডা. খালেদ শওকত আলীকেও প্রস্তুত রেখেছেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই গণসংযোগ করছেন। সম্প্রতি নড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তাকে দলের প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম। তার সঙ্গেই শওকত আলীর মনোনয়নযুদ্ধ হবে বলে দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এ কে এম এনামুল হক শামীম ছাত্ররাজনীতির সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছেন। একই সঙ্গে পুরোদমে নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের কোনো কেন্দ্রীয় নেতা নেই। এ কে এম এনামুল হক শামীম কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ায় নতুন ভোটারদের মধ্যে তাকে ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি এনামুল হক শামীম বলেন, তিনি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। আর মনোনয়ন পেলে তিনি বিজয়ী হবেন। তিনি নির্বাচনে লড়লে দল-মত নির্বিশেষে সবাই তার সঙ্গে থাকবেন। আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা ছোটখাটো সমস্যাও মিটে যাবে। তিনি এখন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।

সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ও নড়িয়া উপজেলার সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাভানা আক্তারও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এ অবস্থায় দলের মনোনয়ন পেলে তিনি বিজয়ী হবেন।

নবম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও নড়িয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ সিমন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন। তিনি এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও নড়িয়া সরকারি কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষ বলেন, এর আগে দলের মনোনয়ন চেয়েও তিনি পাননি। তাই আগামী নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দেবেন বলে তিনি প্রত্যাশায় রয়েছেন।

দলের মনোনয়ন লড়াইয়ে প্রস্তুত ডা. খালেদ শওকত আলী বলেন, তার বাবা শওকত আলীর সঙ্গে মাটি ও মানুষের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বাবার পাশে থেকে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার মানুষের সেবা করছেন। বয়সের কারণে বাবা মনোনয়ন না পেলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এ আসনে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে নেই দলীয় কর্মকাণ্ড। দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও পালন করা হয় না। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের যোগাযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন। তারপরও বসে নেই তারা। একাধিক প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেন্দ্রে লবিং করছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী টি এম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। জেলা বিএনপির সাবেক এই সভাপতির এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি এলাকায় অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনেও তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। আর মনোনয়ন পেলে নির্বাচিত হবেন বলেও আশা প্রকাশ করেছেন এই নেতা।

সাবেক এমপি ডা. কে এম জলিলও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। দলীয় কর্মকাণ্ডে তিনি বেশ সরব। তিনি বলেন, বিএনপি সরকারের সময় তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। এলাকার অসহায় মানুষদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। দলের মনোনয়ন পেলে বিজয়ী হবেন বলে তিনি প্রত্যাশা করছেন।

জেলা বিএনপির সভাপতি ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে শরীয়তপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী শফিকুর রহমান কিরনও দলীয় মনোনয়নের জন্য কেন্দ্রে লবিং চালাচ্ছেন। তবে এলাকায় তিনি ‘বসন্তের কোকিল’ হিসেবে পরিচিত। দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করার পর তিনি উধাও হয়ে যান। নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর কিংবা দলীয় কর্মসূচিতে তাকে পাওয়া যায় না বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি সপরিবারে দুবাই ছিলেন। এসব বিষয় এবং আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।

আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জামাল শরীফ হিরু সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বেশ সক্রিয়। মাঠ পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি জানান, আইনজীবী হিসেবে তিনি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা মোকাবেলা করেছেন। বিএনপি সরকারের সময় এলাকায় তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি এখনও মানুষের মুখে মুখে। তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন।

জেলা বিএনপির আরেক সাবেক সভাপতি সৈয়দ আমীর খসরুর ভাই কর্নেল (অব.) এস এম ফয়সলও দল থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি সর্বস্তরের মানুষের পাশে থেকে তাদের সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। আর ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়নের জন্যই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। তা ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল দীর্ঘসময় এ আসনে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনিও একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। সেই হিসেবে এখানকার মানুষ তাকে নির্বাচনে সাদরে গ্রহণ করবে। তিনি দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment