নারীদের আতঙ্ক গণপরিবহণ

নারীদের আতঙ্ক গণপরিবহণ

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই গণপরিবহণে নারী নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার থামছে না। একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছেই। গণপরিবহণে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। আর গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানী দুইজন কলেজ শিক্ষার্থী হেনস্তার শিকার হয়েছেন। রাজধানীতে ‘নিউ ভিশন’ বাসে কলেজছাত্রীকে হেনস্তার চেষ্টার মাত্র এক সপ্তাহ পরই ঘটলো একই ধরনের ঘটনা।
জানা গেছে, গত শুক্রবার প্রায় একইভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছে অপর এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলো তার বড় বোনও। ঘটনার শিকার ছাত্রী তার উদ্ধার পাওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আর মাত্র ২৪ ঘণ্টায় পোস্টটি ভাইরালও হয়ে গেছে। তিনি ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, আজকে (শুক্রবার) দুপুর ২:৩০টা। আমি আর আমার বোন রমজান বাসে উঠলাম কলাবাগান যাবো বলে। নরমালি তরঙ্গ প্লাস এ যাই। আজকে রমজানে উঠলাম কারণ নতুন চালু হয়েছে মৌচাক-ধানমণ্ডি রুটে। আর বাস এর কন্ডাক্টর বলে, আপা তরঙ্গ আসতে দেরি হবে, উঠেন। বাসে উঠার পর থেকে বাসের কন্ডাক্টর আর হেলপার হা করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আর বাসওয়ালার সঙ্গে কী কী জানি আলাপ করতেছিলো। হঠাৎ এলিফেন্ট রোড সিগন্যাল-এ যাওয়ার পর হেলপার এবং কন্ডাক্টর সবাইকে নামিয়ে দিচ্ছে। তারা বলে, সামনের বাসে যান। সামনে আরেকটা রমজান বাস ছিল- সেটাতে। সবাইকে এক প্রকার জোর করে নামায় দিচ্ছিল। শুধু আমাদেরকে কিছুই বলে না। হঠাৎ আমার বোন আর আমি দেখলাম যে, বাস খালি হয়ে গেছে। শুধু আমরা দুইজন ছাড়া আর দুইজন লোক আছে। উনারা ঝগড়া করছেন বাসওয়ালাদের সঙ্গে, বলে টাকা দিছি যাবি না কেন? বলে- না যাবো না, নামেন আপনারা। উনারা নামার পর আমি আর আমার বোন যখন নামতে যাবো তখন বলে আপনারা নাইমেন না আমরা সিটি কলেজ যাবো তো। যখন নামতে গেলাম হেলপার গেটে হাত দিয়ে বলে নামেন কেন চলেন একটু ঘুরে আসি। আমি একটা ধাক্কা দিয়ে বলি কুত্তার বাচ্চা তরে মাইরা ফেলমু বলে- আমার বোনকে একটা টান দিয়ে নেমে বাস আর পিছে দৌড় দিচ্ছি। অমনি বাস জোরে টান দিয়ে চলে গেলো। বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে ওই শিক্ষার্থী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি আরো বলেছেন, প্রতিদিনই এ ধরনের কাহিনী ফেসবুকে-পেপারে দেখি। আজকে নিজে ফেস করলাম এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। এই শহরে রাতে দিনে কোথাও মেয়েরা সেফ না। কোথায় যাবে মেয়েরা? থানায় অভিযোগ করেছেন কিনা? জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর নিউ মার্কেট থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা করা হয়। পুলিশ রমজান বাসের ওই হেলপারসহ তিনজনকে আটক করেছে।
নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, গত শুক্রবার রাতে রমজান পরিবহণের হেলপার ও কন্ডাক্টরদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে অভিযুক্তদের আটক করা হয়েছে। এর আগে গত ১৭ মার্চ ফার্মগেট এলাকায় একই রকম হেনস্তার শিকার হন ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থী। ঘটনার শিকার ছাত্রী অভিজ্ঞতা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়ে যায়। একপর্যায়ে অভিযোগে থাকা ব্যক্তিরা শনাক্ত হন। পুলিশ নিউ ভিশন বাসে কলেজছাত্রীকে হেনস্তার চেষ্টাকারী বাসচালক মো. দ্বীন ইসলাম (৩৭) ও হেলপার মো. বিল্লাল হাওলাদারকে (২৮) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা পশ্চিম বিভাগ।
ডিবির সূত্র জানায়, ড্রাইভার বললো ‘গেট লাগায় দে’ বাস থেকে লাফিয়ে বাঁচলেন ইডেনের ছাত্রী’– এমন একটি খবর অনলাইন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। পরে বিষয়টি মাথায় নিয়ে অনুসন্ধানে নামে ডিবি (পশ্চিম) বিভাগের একটি দল। ওই ছাত্রীর ফেসবুক পেজের গোপনীয়তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকায় এবং স্ট্যাটাসের প্রতিক্রিয়ায় অসংখ্য মেসেজ পাওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি তার ইনবক্স চেক করা থেকে বিরত থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়। এরপর নিউ ভিশন পরিবহণের বাসের ড্রাইভার ও হেলপারদের ধারাবাহিক জিজ্ঞাসাবাদ, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে অভিযুক্ত বাস ড্রাইভার ও হেলপারকে শনাক্ত করা হয়। বুধবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ওই দুজনকে।
ওই কলেজছাত্রী তার ফেসবুক পেজে আরেকটি স্ট্যাটাসে বলেছেন, গত ১৭ মার্চ বাসে বাড়ি ফেরার পথে নিপীড়নের শিকার হন ইডেন কলেজের এই ছাত্রী। সেই ছাত্রী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিপীড়নের কথা প্রকাশ করেন। ওই ছাত্রী তার ফেসবুক পেজে লেখেন– সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তিনি ফার্মগেটের সেজান পয়েন্ট থেকে মতিঝিল-মিরপুর চিড়িয়াখানা রুটে চলাচলকারী ‘নিউ ভিশন’ পরিবহণের একটি বাসে উঠেছিলেন। বাসে যাত্রী ছিল না বললেই চলে। অস্বস্তি বোধ করছিলেন ওই ছাত্রী। তিনি নেমে যেতে চাইলে বাসচালকের সহকারী (হেলপার) ‘আপা ভয় পাইছে’ বলে রসিকতা করতে শুরু করেন। বাসের দরজাও তিনি রোধ করে দাঁড়ান এবং বাসচালক তাকে দরজা আটকে দিতে বলেন। তখন ওই দুজনের মতো বাসের দু-চারজন যাত্রীও হাসাহাসি করছিলেন। একপর্যায়ে খামারবাড়ি পৌঁছে বাসটি গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করছে বলে মনে করেন ইডেনের ওই ছাত্রী। তিনি বাসচালকের সহকারীকে ধাক্কা দিয়ে নেমে যান। এদিকে গণপরিবহণে গত ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তাদের তথ্যে জানা যায়, এসব ঘটনার চালক-হেলপারসহ অপরাপর সহযোগীরা মিলে গণধর্ষণের ঘটনা ৯টি। ধর্ষণের ঘটনা ৮টি, শ্লীলতাহানি ৪টি সংগঠিত হয়। এ ধরনের ঘটনায় সর্বমোট ৫৫ আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হলেও ৯ এপ্রিল ২০১৭ মানিকগঞ্জে সংগঠিত গণধর্ষণের ঘটনায় এ পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
পর্যবেক্ষণ মতে, ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি রাজধানীর দারুস সালামে চলন্ত বাসে যৌন হয়রানির অভিযোগে গাবতলী-নবীনগর রুটের বাস চালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় পুলিশ গাড়ির চালক ও হেলপারকে আটক করে। একই বছরের ১৩ মার্চ ইজিবাইকে চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে আলমডাঙ্গায় ফিরছিলেন এক স্কুলছাত্রী। ইজিবাইকের ভাড়া মেটাতে না পারার কারণে চালক তাকে ফাঁদে ফেলে আরও তিনজনসহ গণধর্ষণ করে। এরপর ৯ এপ্রিল ঢাকা আরিচা মহাসড়কে চলন্ত বাসে স্বামীর সামনে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঢাকা-সিরাজগঞ্জ রুটে চলাচলকারী এসআই পরিবহণে এঘটনা ঘটে। আর ৩১ জুলাই কুড়িগ্রাম রৌমারীতে পদ্মা পরিবহণের একটি বাসে ঢাকা যাওয়ার পথে গণধর্ষণের শিকার হয় এক কিশোরী গৃহকর্মী। ২০১৭ সালের ১আগস্ট গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ট্রাকের চালক মেহেদী হাসান ও হেলপার সোহান মিলে এক কিশোরীকে চলন্ত ট্রাকে গণধর্ষণ করে। পুলিশ ট্রাকের চালককে আটক করে। আর একই বছরের ৮ আগস্ট বনানীতে এক তরুণীকে প্রাইভেট কারে তুলে নিয়ে শ্লীলতাহানীর চেষ্টা চালানো হয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর ১১ আগস্ট ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় লেগুনার চালক জয়নাল আবেদিন ও হেলপার রিপন এক মাদরাসা ৭ম শ্রেণির ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে। পুলিশ চালক ও হেলপারকে আটক করে। ২৫ আগস্ট বগুড়া ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় চলন্তবাসে গণধর্ষণের শিকার হয় জাকিয়া সুলতানা রুপা। গণধর্ষণের পর ঘাড় মটকে তাকে হত্যা করে মরদেহ রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ তার বেওয়ারিশ মরদেহ উদ্ধার করে। আর আসামিদের গ্রেফতার করে। পরের মাসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বার আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ এলাকায় বাসে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। পুলিশ বাসের চালক জনি বড়ুয়া ও হেলপার এহসানকে এক বছরের কারাদ- দিয়েছে লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুবুল আলম। আর ২৭ অক্টোবর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে নগরীর বহদ্দারহাটে যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে চালক রাশেদুল ইসলাম ও সহকারী ইমতিয়াজ উদ্দিন এক তরুণীকে গণধর্ষণ করে। পুলিশ তাদের আটক করে। আর গত ৩ নভেম্বরে গাজীপুর মহানগরের বাইমাইল এলাকায় নৌকায় তুলে এক পোশাক শ্রমিককে গণধর্ষণ করে ৪ বখাটে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। আর ডিসেম্বরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আনন্দ পরিবহণের যাত্রীবাহী বাসে ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে বাসচালক পারভেজ। এর আগে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী মৈত্রী এক্সপ্রেসে নদীয়ার রেলস্টেশনে বাংলাদেশি এক নারী যাত্রী শ্লীলতাহানির শিকার হয়। এর আগে গত ২০১৫ সালে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে চলন্ত বাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে আটক বাস হেলপার মামুনকে। মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে বাসের মধ্যে ওই ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করেন মামুন।
এসব ঘটনার ব্যাপারে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, প্রতিটা বাসের একজন হেলপার, কন্ট্রাকটর, চালক ও মালিক থাকেন। এদের মধ্যে মালিক অন্যদের নিয়োগ দেন। ওই নিয়োগের সময় যদি তাদের চারিত্রিক বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে তদন্তপূর্বক নিয়োগ দেন, তাহলে বাসের নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো না। ফলে এসব ঘটনার মাস্টার মাইন্ড হচ্ছে বাসের মালিকগণ। তাই তাদেরকেই প্রধান আসামি করা উচিত বলে জানান তিনি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment