আশুলিয়ায় জাবি শিক্ষকের নেতৃত্বে আমবাগানে অবৈধ গ্যাস সংযোগের হিড়িক

আব্দুস সালাম রুবেল, সাভারঃ  আশুলিয়ায় চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের মহোৎসব। তিতাস গ্যাস অফিসের এক শ্রেণির দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদে এবং চিহ্নিত রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় একটা শক্তিশালী দালাল চক্র এই অবৈধ গ্যাস সংযোগের কাজ করে চলেছে। ফলে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব এবং কমছে অনুমোদিত আবাসিক এলাকায় গ্যাসের চাপ। আর দালালদের দৌরাত্মে সাধারণ গ্রাহকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

উল্লেখ্য, প্রায় সাত বছর ধরে সব শ্রেণির গ্রাহককে নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া পুরোনো গ্রাহকদের গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর (লোড বৃদ্ধি) অনুমতি দেওয়াও বন্ধ। এরপরও প্রতিবছর গ্রাহকসংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে গ্যাসের ব্যবহার।  অনিয়ম-দুর্নীতিই এ অবস্থার জন্য দায়ী। জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলা এবং দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণকারী সংস্থা তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনেও এই অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে।

ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ার আমবাগান এলাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন একটি বর্ধিষ্ণু এলাকা। কয়েক বছর ধরে নতুন বাড়ি তৈরীর পাশাপাশি কয়েকটি ‘ডেভেলপার কোম্পানির’ সহায়তায় এখানে চলছে লিফট সমৃদ্ধ ‘হাই-রাইজ ফ্ল্যাট’ তৈরীর রমরমা ব্যবসা। এরকম একটি ৭ তলা ভবনের দুইটি ফ্ল্যাটের মালিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর গ্রেড-২ মোঃ আসাদুজ্জামান। এই ৭ তলা ভবনটি সম্পূর্ণ ওনার মালিকানাধীন জমিতে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রী করে হয়েছে। এছাড়াও আমবাগানের শেষ সীমায় পানধোয়ার কাতে ওনার পাঁচতলা একটি বাড়ি রয়েছে। চলছে আরো কয়েকটি নতুন ভবন তৈরীর কাজ। এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, ওনার নেতৃত্বে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে আমবাগান এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ এবং অতিরিক্ত চুলা ব্যবহারের। শুধু তাইই না, আমবাগানের বেশ কয়েকটি বাড়ির মালিকের সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হয়, সেখানে ভিডিও বক্তব্যে ওনারা একথা জানিয়েছেন যে, প্রতি মাসে এই অবৈধ চুলার জন্য  চুলা প্রতি সরকার নির্ধারিত টাকা তারা এই শিক্ষক আসাদ সাহেবকে প্রদান করেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার!! একজন শিক্ষক একই সাথে অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদান করে আবার বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে গ্যাস বিল বাবদ টাকাও নিচ্ছেন যা সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে না। আর এভাবেই আমবাগান এলাকায় তিনি বানিয়েছেন ৭ তলা বিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট যেখানে নিজের জন্য দুইটি ফ্ল্যাট রেখে বাকিগুলি বিক্রী করেছেন। আমবাগান ও পানধোয়ার কাতে রয়েছে আরো একটি ৫ তলা ভবন যেখানে তার স্ত্রী-কন্যা বাস করেন। এই ভবনের ঠিক পূর্ব দিকের গলিতে একটা তিনতলা নির্মীয়মান ভবন, একটি দুইতলা নির্মীয়মান ভবন এবং আরো একটি ৭ তলা নির্মীয়মান ভবন- এই মোট ৫টি ভবন আমবাগান এলাকায় তার নিজের সম্পদ। এছাড়াও লোকমুখে শোনা যায়, তার আরো অনেকগুলি ভবন রয়েছে সাভার এলাকায়। স্থানীয় লোকদের প্রশ্ন, একজন শিক্ষক কিভাবে এতগুলি বাড়ির মালিক হতে পারেন? তিনি কি আলাউদ্দিনের যাদুর চেরাগ খুঁজে পেয়েছেন?

এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিন ২ জুন, ২০১৮ (শনিবার) অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গিয়ে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। ভিডিও ফুটেজে সে সব অনিয়মের চিত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে যা দেখে মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষকের এমন অবৈধ কর্মকান্ডে যে কেউই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন!

আমবাগান মসজিদের উত্তর পাশের ৭ তলা ফ্ল্যাটটিতে গিয়ে দেখা গেছে, রাইজারের থেকে একটি প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাসের চোরাই লাইন নিয়ে সমস্ত ফ্ল্যাটটিতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। এসময় ফ্ল্যাটের দারোয়ান এবং কেয়ারটেকারের ভিডিও বক্তব্য নেয়া হয়েছে যেখানে তারা এই ভাবে গ্যাস সংযোগের বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। আর এই সমগ্র কাজটি জাবি শিক্ষক মোঃ আসাদুজ্জামান নিজেই করেছেন বলে জানিয়েছেন তারা।

এই অভিযোগের ব্যাপারে ২ জুন (শনিবার) মোঃ আসাদুজ্জামানের মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি কোনো অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেই নাই এবং এধরণের কাজেও আমি জড়িত না। আমি মোট ২০টি চুলার অনুমোদন নিয়ে প্রতি মাসে সেগুলির বিল নিয়মিত পরিশোধ করে আসছি। আর আমার এই গ্যাস সংযোগের ব্যাপারে সাভারের তিতাস গ্যাস অফিসের কর্মকর্তারাও জানেন। তাদেরকে প্রয়োজনে জিজ্ঞেস করুন ।

এপ্রসঙ্গে তাকে তিতাস গ্যাসের কোন কর্মকর্তা এব্যাপারে জানেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর না দিয়ে বলেন, আপনারা খুঁজে বের করে নিন। তখন তার গ্যাস বিল বই দেখাবার জন্য তাকে বাসায় আসতে বললে তিনি তাতে অনীহা প্রকাশ করেন।

‘প্লাস্টিক পাইপ ব্যবহার করে কেন ৭ তলা ফ্ল্যাটটিতে অবৈধ ভাবে গ্যাস সংযোগ নিয়েছেন’- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার দেখার ভুল। ওটা প্লাস্টিক পাইপ না, স্টিলের পাইপ।  অথচ ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হলুদ রঙয়ের প্লাস্টিক পাইপ রাইজার থেকে লাগিয়ে ফ্ল্যাটের ভিতরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এই শিক্ষক সেটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে যান শেষ পর্যন্ত।

পরবর্তীতে ৯ জুন (শুক্রবার) তার আমবাগানস্থ মসজিদ সংলগ্ন ৭ তলা ফ্ল্যটের সেই ভবনে গিয়ে দেখা যায় প্লাস্টিকের পাইপের পরিবর্তে স্টিলের পাইপ লাগানো। তখন ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি ভিডিও বক্তব্যে জানান, দুই দিন আগে প্লাস্টিক পাইপ পরিবর্তন করে আসাদ সাহেব স্টিলের পাইপ লাগিয়েছেন। এসময় এই ফ্ল্যাটে অবস্থান করেও আসাদুজ্জামান  এই প্রতিবেদকের ফোনও রিসিভ করেন নাই এবং নিচে নেমে দেখাও করেন নাই।

সাভারে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) প্রকৌশলী মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান এর কাছে মুঠোফোনে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সব অবৈধ গ্যাস লাইন পর্যায়ক্রমে বিচ্ছিন্ন করে চলেছি। নিয়মিতভাবে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা নির্দিষ্ট এরিয়া ভিত্তিক তদন্ত করে ম্যাজিস্ট্রেট সহ গিয়ে লাইন বিচ্ছিন্নকরণ এবং জরিমানার কাজটি করে থাকি। এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিন, আমরা বিষয়টি অবশ্যই দেখবো।

‘সাভার  তিতাস গ্যাস অফিসের লোকদের ‘নলেজে দিয়েই’  সংযোগ নেয়া হয়েছে’-জাবি শিক্ষকের এমন অভিযোগের বিষয়ে সিদ্দিকুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশ্নই আসে না। আর যদি এমন কোনো অভিযোগ থেকে থাকে তবে প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের মুঠোফোনে কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করাতে এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেয়া যায় নাই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জাবির এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাঁর কাছের মানুষদেরও রয়েছে নানান অভিযোগ। স্ত্রী এবং এক কন্যাকে নিজের জামান ভিলায় রেখে তিনি সাভারে অবস্থিত তার শেয়ারাধীন একটি বিখ্যাত কোচিং সেন্টারের একটি ফ্ল্যাটে অন্য এক নারীর সাথে ‘লিভ-টুগেদার’ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শম্পা নামের এই নারী সাভারের ফুলবাড়িয়া এলাকার এক ট্রাক ড্রাইভারের স্ত্রী যার দুইটি সন্তান রয়েছে। কথিত আছে এই নারীর সাথে বিয়ে না করেও এই নারীর গর্ভে এই শিক্ষকের একটি সন্তানও হয়েছে!

এছাড়া আমবাগান এলাকায় প্রচণ্ড প্রতাপের সাথে বাস করেন জাবির এই শিক্ষক। তাঁর বিভিন্ন  ছাত্রদেরকে তিনি নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগান বলেও অভিযোগ আছে। চাকরি দেবার কথা বলেই মূলত তিনি এদেরকে বশে রাখেন। আর তাঁর গাড়ির ড্রাইভার কাম দেহরক্ষীর বিরুদ্ধেও আছে নানান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ। এজন্য আমবাগান এলাকার সাধারণ বাড়ির মালিকেরা সব জেনেও তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ে কথা বলতে সাহস পান না। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্থানীয় বাড়িওয়ালা জানান, প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে ঐ দলটির প্রভাব এবং জাবি’র একজন শিক্ষক হবার সুবাদে জাবি সংলগ্ন আমবাগান এলাকাটিতে আসাদুজ্জামানের একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই সব কিছু দেখেও কারোর কিছুই করার নাই।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment