ঢাকা-২ আসনে প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে ঘিরে দ্বন্দ্ব-বিরোধ চরম পর্যায়ে

ঢাকা-২ আসনে প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে ঘিরে দ্বন্দ্ব-বিরোধ চরম পর্যায়ে

ঢাকা-২ (কেরানীগঞ্জ আংশিক-কামরাঙ্গীরচর-সাভার আংশিক) আসনে আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে ঘিরে দ্বন্দ্ব-বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমান এমপি খাদ্যমন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মাঠে নেমেছেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। দুই নেতার বিরোধকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তাদের কর্মী ও সমর্থকরা।

এদিকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা জাতীয় পার্টির সভাপতি শাকিল আহমেদও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। মহাজোটগত সমঝোতায় গত দুই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েও শেষপর্যন্ত তিনি সরে দাঁড়ান। কিন্তু এবার তিনি ছাড় দিতে নারাজ। যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে মহাজোটের দুই শরিক আওয়ামী লীগ ও জাপার মধ্যে দেখা দিয়েছে অস্বস্তি।

কেরানীগঞ্জ উপজেলার হযরতপুর, কলাতিয়া, তারানগর, শাক্তা, কালিন্দী, রোহিতপুর ও বাস্তা ইউনিয়ন, হাজারীবাগের সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কামরাঙ্গীরচর থানার ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড এবং সাভার উপজেলার আমিনবাজার, তেঁতুলঝোড়া ও ভাকুর্তা ইউনিয়ন নিয়ে ঢাকা-২ আসন। এই আসনটি ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকা-৩ ভেঙে পুনর্বিন্যাস করা হয়।

গত দুই নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ২০০৮ সালে প্রথমবার প্রার্থী হন। ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী অধ্যক্ষ অধ্যাপক মতিউর রহমানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে চমক দেখান এবং মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে আইন প্রতিমন্ত্রী করা হয় তাকে। এ সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন অ্যাডভোকেট কামরুল। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এই উপদেষ্টা।

একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অ্যাডভোকেট কামরুল এলাকায় নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন। দুই মেয়াদে এমপি হয়ে এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দলের নীতিনির্ধারক ও প্রভাবশালী মন্ত্রীদের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। তার সমর্থকদের দাবি, তৃতীয়বারের মতো এই আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে অ্যাডভোকেট কামরুলকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে হাইকমান্ড।

যদিও এ দাবি মানতে নারাজ মনোনয়নপ্রত্যাশী উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তিনিও নির্বাচনী এলাকায় শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। গত নির্বাচনে ব্যাপক শোডাউন করে মনোনয়নপত্র কিনলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কামরুল ইসলামকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়ান শাহীন। এবার তিনি ছাড় দিতে রাজি নন। দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন তিনি। দলীয় মনোনয়নের জন্য হাইকমান্ডে লবিং অব্যাহত রেখেছেন। পাশাপাশি দলীয় কর্মকাণ্ডে বিপুল সমারোহে অংশগ্রহণ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কেরানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হিসেবে প্রত্যেক ইউনিয়নে ওয়ার্ড সম্মেলন করে দলকে সুসংগঠিত রেখেছেন। এছাড়া ঢাকা-২ আসনভুক্ত সাত ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থীদের চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী করতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন শাহীন। সম্প্রতি এসব ইউপি চেয়ারম্যানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেও চমক দেখিয়েছেন তিনি।

এছাড়া দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখছেন শাহীন চেয়ারম্যান। প্রাথমিক শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ ও ২০১৬ সালে শ্রেষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পেয়েছেন তিনি। এলাকার তরুণ ভোটারদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে তার।

এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে কামরুল ও শাহীনের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছে। তাদের কর্মী-সমর্থকরা পৃথকভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পালন করছেন এবং আলাদাভাবে দু’জনের ছবি দিয়ে পোস্টার ও ব্যানার টাঙানো হচ্ছে। সম্প্রতি শাহীন সমর্থকরা কামরাঙ্গীরচরে নির্বাচনী পোস্টার লাগাতে গেলে কামরুলের সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালান। এর প্রতিবাদে শাহীনের নেতৃত্বে ওই এলাকায় বড় ধরনের শোডাউন হয়। দুই নেতার বিরোধের জের ধরে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হচ্ছে। দলীয় কোন্দলের কারণে আসনভুক্ত কয়েকটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা যাচ্ছে না। শাহীনকে কোণঠাসা করতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে নানা সময়ে হস্তক্ষেপ করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগে এমন বিরোধের সুযোগ নিয়ে মহাজোটের প্রার্থী হওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছেন জাতীয় পার্টির শাকিল আহমেদ। জোটগত সমঝোতায় গত দুই নির্বাচনে তিনি ছাড় দিয়েছেন। এই আসনে সাংগঠনিকভাবে জাপার অবস্থা দুর্বল। এরপরও যেকোন মূল্যে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শাকিল। স্থানীয়দের মতে, জাপা একক প্রার্থী দিলেও এ আসনে সুবিধা করতে পারবে না।

তবে আওয়ামী লীগের এই কোন্দলে সুবিধা পাবে বিএনপি। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বললেন, এক সময় এই আসন বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। আগামী নির্বাচনে তারা আসনটি ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে আছেন। আওয়ামী লীগের দুই নেতার বিরোধ অব্যাহত থাকলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সহজ হবে। বিভিন্ন দল থেকে আসা ‘হাইব্রিড’ নেতাকর্মীদের গ্রুপিংয়ের জন্য দায়ী করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ।

অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম  বলেন, দুবার এমপি ও মন্ত্রী হয়ে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। কোনো অনিয়মের সঙ্গে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত নন। আগামী নির্বাচনে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো তাকে মনোনয়ন দেবেন এবং তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাসী কামরুল। তব দল থেকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে কাজ করবেন বলেও অঙ্গীকার করে তিনি।

শাহীন আহমেদ বলেন, দলের প্রতি আনুগত্য দেখানোর কারণে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করা হয়েছে। বিএনপি আমলে তার বাড়িতে হামলা হয়েছে। এর পরও দলের দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের ছেড়ে যাননি। দল ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছেন। কেরানীগঞ্জের সাতটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মী তার পক্ষে রয়েছেন। সাধারণ মানুষও তাকে সমর্থন করছেন। এসব ত্যাগ, জনপ্রিয়তা ও নেতাকর্মীদের সমর্থন বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেবেন বলে আশাবাদী শাহীন চেয়ারম্যান। মনোনয়ন পেলে জয়ী হবে বলে বিশ্বাস তার।

শাকিল আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগকে গত দুটি নির্বাচনে ছাড় দিয়েছেন তিনি। মনোনয়নপত্র দাখিল করেও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তবে এমন ছাড়ের পরও এই সরকারের সময় জাতীয় পার্টি কোনোভাবে উপকৃত হয়নি। দলের নেতাকর্মীদের ধরেও রাখা যাচ্ছে না। এ কারণে আগামী নির্বাচনে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment