সরকারি গুদামে ‘সরকারি’ চাল বিক্রি

চলতি বোরো মৌসুমের শেষ পর্যায়ে এসে সম্প্রতি মেয়াদ বাড়িয়ে আরও সাড়ে ৪ লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। একই সময়ে দেশব্যাপী হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকার চাল বিক্রিও চলবে। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, একই সময়ে চাল সংগ্রহ এবং হতদরিদ্রদের মাঝে চাল বিক্রি হলে বড় ধরনের অনিয়মের আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে একটি চক্র হতদরিদ্রদের কাছ থেকে ১০ টাকার চাল দ্বিগুণ দামে কিনে আবার সরকারি খাদ্য গুদামে বিক্রি করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। কয়েক হাত বদল হয়ে সরকারের চাল সরকারি খাদ্য গুদামেই বিক্রির মাধ্যমে এর আগেও বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র।

মাঠ পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা জানান, সরকারের সংগ্রহ মৌসুমে সামাজিক খাতে চাল বিতরণ কর্মসূচি চালু থাকলে অনিয়মের আশঙ্কা এড়ানো যায় না। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৩০ জুন ক্লোজিং সময়ে সরকার টিআর, কাবিখা, ভিজিএ, ভিজিডিসহ নানা প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়।

অসাধু রাজনীতিক ও দুর্নীতিবাজ খাদ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বরাদ্দের ওই চাল স্থানীয় প্রশাসন আবার খাদ্য গুদামে সরবরাহ করে। সম্প্রতি ঘাটাইলের সরকারি খাদ্য গুদামের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কাবিখার চাল বোরো মৌসুমে মিলারদের কাছ থেকে ক্রয় দেখিয়ে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে খাদ্য অধিদপ্তর তদন্ত করছে বলে জানা যায়।

সংশ্নিষ্ট সূত্রমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারকল্পে কাবিখা কর্মসূচির অন্তত আড়াই হাজার টন চাল ২০ টাকা কেজি দরে প্রকল্প সংশ্নিষ্টদের কাছ থেকে কিনে নেয় একটি সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী গ্রুপ। ওই ব্যবসায়ীরাই গুদাম কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে বিভিন্ন মিলারের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ওই চাল বিক্রি করে। শুধু কাবিখার এ চালই নয়; একই অর্থবছরের টিআর কর্মসূচির চালও দেশের বিভিন্ন স্থানে বোরো প্রকিউরমেন্টে ক্রয় দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে জামালপুরের ইসলামপুরের সরকারি খাদ্য গুদামের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

এদিকে চলতি বোরো মৌসুমে সরকারি খাদ্যশস্য ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবারও একক সিদ্ধান্তে চাল সংগ্রহ করেছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন হয়নি। ৯ জেলা থেকে নামমাত্র ধান সংগ্রহ করে বাকিটা চালে রূপান্তর করে নেয় খাদ্য অধিদপ্তর। বোরো মৌসুমের শেষ পর্যায়ে মেয়াদ বাড়িয়ে বর্তমানে আরও সাড়ে ৪ লাখ টন চাল কেনা হচ্ছে। অতিরিক্ত চাল কিনতে সময় বাড়ানো হয়েছে ১৫ দিন। দ্বিতীয় মেয়াদে আরও ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে বোরো মৌসুমের খাদ্যশস্য সংগ্রহের সময়সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর করার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সময়ে দেশের উপজেলা পর্যায়ে ১০ টাকার চাল বিক্রিও চলবে হতদরিদ্রদের মাঝে।

অভিযোগ রয়েছে, বর্ধিত সময়ে তালিকাভুক্ত ডিলারদের বাদ দিয়ে বন্ধ থাকা মিলের নামে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে চাল কিনছেন খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, খাদ্য অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাদের যোগসাজশে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাকর্মী সরকারি গুদামে ঢালাওভাবে চাল সরবরাহ করছেন। বাজার থেকে ৩০-৩২ টাকা কেজি দরের নিম্নমানের চাল কিনে ৩৮ টাকা কেজি দরে সরবরাহ করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ধান-চাল কেনার ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নেয়, অধিদপ্তর তা-ই বাস্তবায়ন করে। এ ক্ষেত্রে অধিদপ্তর একক কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না।

যোগাযোগ করা হলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, বর্তমানে দেশে সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ সন্তোষজনক। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সামাজিক নানা খাতে অন্তত ৮ লাখ টন চালের প্রয়োজন হবে। আশা করা যাচ্ছে, এ চাল বিতরণের পরও ডিসেম্বরের দিকে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকবে। উপজেলা পর্যায়ে হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকায় চাল বিক্রির সময়ে বোরো চাল সংগ্রহের সময় বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব বলেন, কিছু টেকনিক্যাল কারণে এ সময় বৃদ্ধি করতে হয়েছে। তবে এ দুটো কর্মসূচি একসঙ্গে চলায় কিছু অনিয়ম হতে পারে। তবে তা খুব বেশি হওয়ার সুযোগ নেই।

অতিরিক্ত সাড়ে ৪ লাখ টন চাল সংগ্রহের বিভাজন প্রক্রিয়ার অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, এখানে ঢালাওভাবে অভিযোগ করার সুযোগ নেই। তবে মন্ত্রীর কাছে কোনো সংসদ সদস্য বা রাজনৈতিক নেতা যদি কোনো দাবি করেন, তিনি নিশ্চয় তা ফিরিয়ে দেবেন না। যদিও কথাটি অনুমাননির্ভর বলে দাবি করেন খাদ্য সচিব।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, সরকারি খাদ্যশস্য ক্রয়কালে সব সময়ই কমবেশি অনিয়ম হয়। চলতি বোরো মৌসুমে দ্বিতীয় মেয়াদে চাল কেনার বিভাজন প্রক্রিয়ায় কমবেশি অনিয়ম হয়েছে- এ কথা স্বীকার করতেই হয়। কিছু বন্ধ মিল চাল কেনার বরাদ্দ পেয়েছে, এমন তথ্যও রয়েছে। তবে তা ঢালাওভাবে হয়েছে, বলা যায় না। তিনি বলেন, অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্রকিউরমেন্টের সময়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা হস্তক্ষেপ করতেন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও অনেকেই হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেন। তবে তা অতীতের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। বিশেষ করে বাজারমূল্যের সঙ্গে সরকারি মূল্যের ব্যবধান খুব একটা না থাকায় এই হস্তক্ষেপটা কমে এসেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে ১৫ লাখ ৮৪ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে চাল ১৩ লাখ ৩৪ হাজার টন এবং গম আড়াই লাখ টন। এ ছাড়া বন্দরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে ৫২ হাজার টন খাদ্যশস্য। গত বছর এই সময়ে সরকারি খাদ্য গুদামে মজুদকৃত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার টন। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। মূলত সরকারের শেষ সময়ে সামাজিক খাতে সরকারের নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাই খাদ্যশস্যের মজুদ রেকর্ড পরিমাণ করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত এপ্রিলে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় সরকার দেশের কৃষকের কাছ থেকে দেড় লাখ টন ধান এবং ৯ লাখ টন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ মে থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাল কিনতে শুরু করে খাদ্য অধিদপ্তর। ধান কেনা শুরু করে ১৩ মে থেকে। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি দেড় লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত দিলেও কেনা হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ২০০ টন। দেশের ৯ জেলা সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, এবং কিশোরগঞ্জ থেকে এ ধান কেনা হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অধিশাখা) ড. অনিমা রানী নাথ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে বলা হয়। ওই সময়ে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফুর রহমান অপু বলেছিলেন, হাওর এলাকার ধান পড়ে যাওয়ায় সরকার কৃষকদের প্রাধান্য দিয়ে সীমিত আকারে ধান কেনা শুরু করে। পরে আরও ধান কেনা হবে। তবে ওই সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়ন হয়নি। এক লাখ ৩৫ হাজার টন ধানকে চালে রূপান্তর করে চালকল মালিকদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। একই সঙ্গে অনুমোদন ছাড়াই আরও সাড়ে ৪ লাখ টন চাল কেনা হয়। এ ছাড়া আরও এক লাখ টন চাল কেনা হবে বলে গুঞ্জন রয়েছে। চাল কেনার পর বিভিন্ন সময়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় এসব চাল কেনা অনুমোদন করা হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment