জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক মেয়ে II আজমীরা চায়ের স্টলের গল্প

বিকাশ চন্দ্র প্রাং, স্টাফ রিপোর্টার, নওগাঁঃ

জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে চা ব্যবসাকে বেছে নিয়েছেন আজমীরা। তার নামেই রাখা হয়েছে ‘আজমীরা টি স্টল’। নওগাঁর রানীনগর উপজেলা সদর- আবাদপুকুর সড়কের রেল গেটের পরিত্যাক্ত দুইটি ইটের ঘর। এক সময় ওই ঘরে রেলের গেটম্যান থাকতেন। তবে এখন ওই ঘরে আর গেটম্যান থাকেন না। আর এ পরিত্যাক্ত ঘরের একপাশে টিনের বেড়া। অপর পাশে পলিথিনে ঘেরা। রেল গেটের পরিত্যাক্ত এ দুটো ঘরের একটিতে বসবাস করেন আজমীরারা। যেটি একটু বড়। আর অপরটি একটু ছোট। এ ছোট ঘরেই চায়ের স্টল। চায়ের দোকানটি রেল লাইনের একে বারেই নিকটে। প্রায় ১০ ফুট দুরত্বে। রেল লাইন পার হয়ে উপজেলা সদরে প্রবেশ পথের ডান দিকে ও আবাদপুকুর সড়কের মুখে বাম পাশে চায়ের দোকানটি হওয়ায় চোখে পড়ার মতো। আজমীরাদের গ্রামের বাড়ি উপজেলার বিষ্ণপুর দিঘীর পাড়ে। ভূমিহীন দরিদ্র এ পরিবারটি গত ২০ বছর হলো রেল গেটের পরিত্যাক্ত ভবনে এসে উঠে এসেছেন। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতজন। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে আজমীরা দ্বিতীয়। সবার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা আজিজার রহমান আকন্দ প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে একটি বাজারে চায়ের দোকান করেন। অভাবের সংসার হওয়ায় পড়াশুনার তেমন সুযোগ হয়ে উঠেনি তার। তারপরও ৯ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। সংসারে অভাব অনটনের কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে পড়াশুনা। এরপর সংসারের হাল ধরেছেন। তবে বিয়ের পিড়িতে এখনও বসা হয়নি তার। গত ১০/১২ বছর থেকে তিনি ওই চায়ের দোকান করছেন। চায়ের সাথে রয়েছে-বিভিন্ন বিস্কিট, কেক, রুটি, কলা ও বিড়ি-সিগারেট। প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মতো বেঁচাবিক্রি হয়। লাভের অংশটা পরিবারের কাজেই খরচ করতে হয়। আজমীরার চায়ের দোকান রেলগেটের পাশে মানে, দোকানের সামনেই রেল লাইন। রেল লাইনে দোকান হওয়ায় ভোর থেকে শুরু হয়ে চলে রাত ১০-১১ টা পর্যন্ত। এসুবাদে ট্রেনের আসা-যাওয়া বুঝতে পারেন আজমীরা। এ কারণে রেল লাইন পার হওয়া মানুষদের সর্তক করতে পারেন। তার কারণে দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে কয়েকটি জীবন। স্বাক্ষীও হয়ে আছেন কয়েকটি দূর্ঘটনার। আর এ রেল লাইন দিয়ে ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী ট্রেনের আসা-যাওয়া। রানীনগর উপজেলা সদরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া রেল লাইনের উপর দিয়ে প্রতিদিন ট্রাক, ট্রাক্টর, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, ভটভটি, অটো র্চাজার, ভ্যান, সাইকেলসহ লাখো মানুষের পারাপার। জানা গেছে, প্রায় ৫/৬ মাস আগে রেলগেটটি বন্ধ ছিল। প্রায় ৩ মাস বন্ধ থাকার পর গেটম্যান নিয়োগ দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। মা রেনুকা বিবি বলেন, এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। রেলের পুরনো ঘরে সবাইকে নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করি। নওগাঁ-নাটোর সড়ক হবে শুনছি। রাস্তা হলেতো এ ঘরটিও ভাঙা হতে পারে। তখন আর এখানে থাকতে পারবো না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি। কোথায় থাকব এখনো ঠিক হয়নি। তবে রাস্তা হলে এখানে আর থাকা হবেনা এটাই জানি। আজমীরা বলেন, গেটম্যান হয়ত ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেনা। এসময় ট্রেন চলে আসলে লোকজনকে সর্তক করি। অনেক সময় নিজেরাই গেট নামিয়ে দিই। যারা রেল লাইন পারাপার হয় ট্রেন আসছে কি না, সেটা না দেখেই পার হয়ে যায়। অনেকে আবার ট্রেন কাছাকাছি আসলেও পার হওয়ার চেষ্টা করেন। তখন হাত উচিয়ে এবং হাক/ডাক দিয়ে লোকজনকে সর্তক করে থামিয়ে দিই। তিনি আরো বলেন, প্রায় তিন বছর আগের একটি দূর্ঘটনা। উপজেলার রাজাপুর বালুভরা গ্রামে হামিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি তার মেয়েকে রাতে সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠিয়ে দেন সান্তাহারে। মেয়েকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে রাত সাড়ে ১১ টার দিকে আবার ফিরে আসছিলেন। অসাবধানতা বসত রেল লাইন পার হওয়ার সময় ওই ট্রেনেই মোটর সাইকেল নিয়ে সংঘর্ষে মারা যান। ওই সময় সবাই ভাত খাচ্ছিলাম। একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। এসে দেখি মাথায় আঘাত লেগে রেলে লাইনে পাশে পড়ে আছে। চায়ের দোকানের নিয়মিত ক্রেতা ভ্যান চালক ময়নুল হক বলেন, এরা অনেক মানুষের দূর্ঘটনার হাত থেকে জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছেন। মানুষদের সচেতন করে। গেটম্যান আসতে দেরী করলে নিজেরাই গেট নামিয়ে দেয়। উপজেলার মালশন গ্রামের সবুজ সরদার বলেন, নিয়মিত রেল লাইন পার হয়ে উপজেলায় আসা-যাওয়া করতে হয়। মাস কয়েক আগে একদিন বিকেলে একটা কাজের জন্য তড়িঘড়ি করে উপজেলা বাজারের দিকে আসছিলাম। রেলগেট পড়ে আছে। পার হওয়ার চেষ্টা করতেই চায়ের স্টলের ওই মহিলা (আজমীরা) হাঁক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। দেখি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রেন চলে আসছে। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গিয়েছি।#

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment