ওবায়দুল কাদের শঙ্কামুক্ত নন

ওবায়দুল কাদের শঙ্কামুক্ত নন

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। গতকাল ১৯ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে তার চিকিৎসায়।
গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওবায়দুল কাদেরের বুকে ব্যথা অনুভব হলে বিএসএমএমইউর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক গতকাল ভোরে বিএসএমএমইউতে নিয়ে যান। সেখানে ধরা পড়ে আওয়ামী লীগের এ নেতার হার্ট ফেইলিউরের বিষয়টি। এনজিওগ্রাম করা হলে ধরা পড়ে তার হার্টের তিনটি ব্লক। এর মধ্যে একটি আর্টারিতে রিং পরানো হলে বন্ধ হয়ে যাওয়া রক্ত চলাচল ফের শুরু হয়।
দলের সাধারণ সম্পাদকের এমন সঙ্গিন অবস্থার সংবাদ যখন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কানে পৌঁছায়, তখন তিনি রাজশাহীতে সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন। তিনি ঢাকায় ফিরেই বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হাসপাতালে যান ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে। প্রধানমন্ত্রী তার শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডাক দেন। এমন সঙ্গিন অবস্থায়ও ওবায়দুল কাদের

তখন চোখ খোলার চেষ্টা করেন। প্রধানমন্ত্রীর মিনিট দশেক পর হাসপাতালে পৌঁছান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এর পর আসেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
এদিকে, তাকে উন্নত চিকিৎসা দিতে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেও চিকিৎসকরা মনে করছেন, তার এখন যে পরিস্থিতি, তাতে পাঠানো সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, ওবায়দুল কাদেরের অসুস্থতার খবর দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর দলের অসংখ্য নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা ছুটে আসেন হাসপাতালে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিক আয়োজন করা হয় তার আরোগ্য কামনায় দোয়া মাহফিল।
ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, রাতে ওবায়দুল কাদেরের বুকে ব্যথা হলে আমাদের একজন চিকিৎসক তার বাসায় গিয়ে শারীরিক অবস্থা দেখেন। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একপর্যায়ে উনি শ্বাস নিতে পারছিলেন না। এর পরই ওনার কার্ডিয়াক এরেস্ট (হার্ট অ্যাটাক) হয়। আমরা সিবিআর এবং এর পরপরই ভেন্টিলেশন যুক্ত করলে হার্ট ফের চালু হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, উনার তিনটি আর্টারিই ব্লকড। আর্টারিগুলোর মধ্যে একটি পুরোপুরি, একটি ৮০ শতাংশ ও তৃতীয়টি ৯৯ শতাংশই ব্লক হয়ে ছিল। আমরা অন্তত একটি ব্লক খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং একটি রিং পরাই। এর পর তার রক্ত চলাচল কিছুটা বাড়ে। ড. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থা ক্রিটিক্যাল (সংকটপূর্ণ)। আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া তার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।
এর পর তিনি আওয়ামী লীগের এ নেতার সুস্থতা কামনা করে দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করেন। আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ওবায়দুল কাদেরের হার্টের কার্যক্রম ফের স্বাভাবিক হবে।
বিএসএমএমইউর ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া জানান, রাষ্ট্রপতি তার পাশে দাঁড়িয়ে যখন নাম ধরে ডাকেন, ওবায়দুল কাদের তখন ক্ষণিকের জন্য চোখ মেলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যারা চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা যদি মনে করে তা হলে ওবায়দুল কাদেরকে বিদেশ পাঠানো হবে। তারা যদি প্রয়োজন মনে না করেন তা হলে পাঠানোর দরকার নেই। তিনি আরও বলেন, এমন হতে পারে পরিস্থিতি পাঠানোর মতো না। তা হলে কিন্তু উনাকে বিদেশ পাঠানো হবে না।
তিনি আরও বলেন, বিদেশ থেকে যে টিম আসছে সেই টিমের সদস্যরা যদি মনে করেন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে কোনো সমস্যা হলে সেটি মোকাবিলা করার মতো তাদের প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ যদি থাকে, তা হলে আমরা বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
ভিসি গতকাল বিকালে এ তথ্য জানান। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছেন বিশ্বখ্যাত সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের দুই চিকিৎসক। বিষয়টি নিয়ে গতকাল রাতে বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন জানান, আগত চিকিৎসকরা ওবায়দুল কাদেরকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। তবে তারা এটাও বলছেন, এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সাপোর্ট না থাকায় তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি আরও জানান, সিঙ্গাপুরে নেওয়া হবে কিনা, তা চূড়ান্ত করতে আলোচনা চলছে; কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান গতকাল বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদককে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। সংসদ অধিবেশন চলছিল বলে তাকে প্রশ্ন করা যায়নি, কখন ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এদিকে সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্যারকে আজ রাতে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ তাকে দেওয়া মেডিক্যাল সাপোর্টসহ বিমানে উঠানো এবং হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সর্বশেষ, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম সংসদ অধিবেশনের ফাঁকে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলাপকালে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে বলেন, সিঙ্গাপুরে যেতে চার ঘণ্টা ফ্লাই করতে হবে। কিন্তু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) পর্যাপ্ত সাপোর্ট নেই। তাই আজ রাতে (গতকাল) তাকে নেওয়া হবে না। আগামীকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত তার শারীরিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকরা। তবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষমাণ থাকবে, যতক্ষণ প্রয়োজন হয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এবং মেডিকেল টিমের তিন চিকিৎসককে আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
গতকাল আওয়ামী লীগ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর কাছে ওবায়দুল কাদেরের সুস্থতা কামনায় দোয়া চেয়েছেন। বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন দেশের সব উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা আয়োজনের। পাশাপাশি তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন, বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্যান্য রোগীর ভোগান্তি না হয়, তা বিবেচনায় রেখে নেতাকর্মীরা যেন হাসপাতালে ভিড় না করেন।

হাসপাতালে উদ্বিগ্ন নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের ভিড়
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের অসুস্থতার খবর শুনে গতকাল সকাল থেকেই দলের ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এবং শুভাকাক্সক্ষীরা হাসপাতালে আসতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, সালমান এফ রহমান, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মেদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ, কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য এসএম কামাল হোসেন, ইকবাল হোসেন অপু, বিএমএর সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল হাসপাতালে এসে ওবায়দুল কাদেরের খোঁজখবর নেন। আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়াসহ দলের অনেক নেতাকর্মী প্রায় সারাদিনই হাসপাতালে ছিলেন।
গতকাল বিকালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দেখে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ের দলের সাধারণ সম্পাদকের শারীরিক সুস্থতা কামনায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতারা এ সময় সাধারণ সম্পাদকের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান ও তার আশু রোগমুক্তি কামনা করেন।
ওবায়দুল কাদেরের অসুস্থতার খবরে রোগমুক্তি কামনায় নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করে। গতকাল বিকালে নোয়াখালী সদর উপজেলা পরিষদের আয়োজনে উপজেলা অডিটোরিয়ামে কোরআনখানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিন ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান নাছির। বাদ আসর ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনী এলাকা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাটে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কার্যালয়ের মসজিদেও গতকাল আসর নামাজের পর ওবায়দুল কাদেরের আরোগ্য কামনায় দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান (অতিরিক্ত সচিব)।

কাদেরের শয্যাপাশে বিএনপি নেতৃবৃন্দ
ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে গতকাল বিএসএমএমইউ হাসপাতালে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলটির প্রবীণ দুই নেতা মওদুদ আহমদ ও ড. মঈন খান। এ সময় তারা আওয়ামী লীগ নেতার শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ ও চিকিৎসা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। বিএনপির পক্ষ থেকে সহমর্মিতা প্রকাশ করে ওবায়দুল কাদেরের আশু আরোগ্যলাভে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া কামনার কথা বলেন মির্জা ফখরুল।

সর্বশেষ
বিএসএমএমইউর ভিসি ডা. কনক কান্তি বড়–য়া গতকাল রাত সাড়ে ১১টায় আমাদের সময়কে জানান, রাত ১০টার পর ওবায়দুল কাদেরের জ্ঞান ফিরেছে। কেউ ডাকলে তিনি সাড়া দিচ্ছেন; হাত-পা নাড়ছেন। সব মিলিয়ে তার অবস্থা একটু হলেও উন্নতির দিকে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment