গলদ মেশিনে না মানুষে

বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের প্রধান এ বিমানবন্দরে ৩টি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে একজন যাত্রী খেলনা পিস্তল ও বোমাসদৃশ বস্তু নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে উঠে পড়েন। পরে ওই যাত্রী ঢাকা থেকে দুবাইগামী বিমানটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন।

ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই ৫ মার্চ এক যাত্রীর পিস্তল নিয়ে প্রথম নিরাপত্তা তল্লাশি পেরিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এর পর ৮ মার্চ আরেক যাত্রীও একইভাবে পিস্তল নিয়ে প্রথম নিরাপত্তা তল্লাশি পেরিয়ে যান। এসব ঘটনা শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কেন বারবার এমন ঘটনা ঘটছে? প্রশ্ন নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। সমস্যা কি নিরাপত্তাকর্মীদের, নাকি লাগেজ স্ক্যানার মেশিনের? এমন প্রশ্নও তুলছেন তারা।

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে কর্তব্যরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খেলনা পিস্তল নিয়ে এক যাত্রীর বিমানে উঠে পড়া এবং পিস্তল নিয়ে দুই যাত্রীর প্রথম নিরাপত্তা তল্লাশি পেরিয়ে যাওয়ার ঘটনার নেপথ্যে নিরাপত্তাকর্মীদের গাফিলতির বিষয়টিই মুখ্য হিসেবে উঠে আসছে। প্রথম ঘটনায় বিমানবন্দরের সকল নিরাপত্তা তল্লাশি পেরিয়ে খেলনা পিস্তল নিয়ে বিমানে উঠে যান পলাশ আহমেদ নামের এক যাত্রী। পরে তিনি বিমানটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। পলাশ তার সঙ্গে রাখা ব্যাগটি স্ক্যানার মেশিনে স্ক্যান করিয়েই বিমানে উঠেছিলেন।

এ ছাড়া প্রতিটি আর্চওয়ে গেটও পেরিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু কোনো নিরাপত্তা তল্লাশিতেই তার কাছে থাকা পিস্তলটি ধরা পড়েনি। এ ঘটনায় দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে ইতোমধ্যে পাঁচ নিরাপত্তাকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত এবং একজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরও আগে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। খেলনা পিস্তল নিয়ে একজন যাত্রীর বিমানে উঠে পড়া এবং পরবর্তীতে বিমানটি ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা ঘটার পর শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।

এর পরও ৫ ও ৮ মার্চ পিস্তল নিয়ে দুই যাত্রীর প্রথম নিরাপত্তা তল্লাশি ধাপ পেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুটো ঘটনাতেই বিমানবন্দরের আর্চওয়ে গেট ও লাগেজ স্ক্যানিং অপারেটরদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। ৫ মার্চ পিস্তল নিয়ে প্রথম নিরাপত্তা ধাপ পেরিয়ে যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। এ কা-ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা গত বৃহস্পতিবার সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে একটি ‘লুজ নোট’ দাখিল করেছেন।

নোটে উল্লেখ করা হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত স্ক্যানিং অপারেটর মিজানুর রহমান দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তখন তাকে সরিয়ে ফাজলার রহমান নামে আরেক নিরাপত্তা অপারেটরকে লাগেজ স্ক্যানিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি প্রথম ধাপের নিরাপত্তা স্ক্যানিংয়ের সময় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ব্যাগে থাকা পিস্তলটি শনাক্ত করতে পারেননি। পরে দ্বিতীয় ধাপে ‘অ্যান্টি হাইজাকিং’ পয়েন্টে পিস্তলটি শনাক্ত হয়।

এ ঘটনায় দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে নিরাপত্তা অপারেটর ফাজলার রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অথচ খেলনা পিস্তল নিয়ে যাত্রীর বিমানে উঠে যাওয়ার ঘটনার জেরে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ লাগেজে অস্ত্র রেখে বিমানবন্দরের প্রতিটি লাগেজ স্ক্যানিং মেশিনে দিয়ে তা স্ক্যানিং করে। প্রতিটি ঘটনাতেই অস্ত্রের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। জানা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রতিদিন শতাধিক যাত্রীবাহী বিমান উঠানামা করে।

এসব বিমানের কয়েক হাজার যাত্রীর লাগেজ প্রতিদিন স্ক্যানিং করতে হয়। বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে মোট ৩২টি লাগেজ স্ক্যানিং মেশিন রয়েছে। আর এসব মেশিন পরিচালনায় প্রশিক্ষিত অপারেটর রয়েছেন শতাধিক। ৩ শিফটে তারা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই স্বল্পসংখ্যক অপারেটর দিয়ে কয়েক হাজার লাগেজ স্ক্যানিং করা অনেকটাই দুরূহ বলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন। তারা বলছেন, দীর্ঘক্ষণ লাগেজ স্ক্যানিং করার ফলে নিরাপত্তা অপারেটররা স্ক্যানিং মেশিনের রেডিয়েশনের কারণে অনেক সময় চোখে ঝাপসা দেখেন।

এ ছাড়া তাদের মাথাব্যথাও দেখা দেয়। এসব কারণে অপারেটরদের মনোযোগে বিঘœ ঘটে। এরই ফাঁকে বিপজ্জনক বস্তু স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এ থেকে উত্তরণে বিমানবন্দরের প্রতিটি লাগেজ স্ক্যানিং মেশিনে আরও বেশি প্রশিক্ষিত অপারেটর নিয়োগের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, বিমানবন্দরে নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব আছে বলে মনে করি না। তবে এসব যন্ত্রপাতি যারা পরিচালনা করেন, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং দায়িত্ব পালনে যথার্থ মনযোগের ঘাটতি থাকতে পারে। যে সব ঘটনা ঘটেছে, এসবের কারণে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় বড় ধরনের ত্রুটি আছে বলে আমি মনে করি না। তবে বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা মানুষের প্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছায়নি।

তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং দায়িত্ব পালনে মনযোগী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) রুলস অনুযায়ী, প্রতিটি লাগেজ স্ক্যানিং মেশিনে অন্তত দুজন প্রশিক্ষিত স্ক্যানিং অপারেটর দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনবলের স্বল্পতার কারণে এ বিধি পরিপালন করতে পারছে না সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাঈম হাসান আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্বখ্যাত ব্যাপ ব্র্যান্ডের স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের লাগেজ স্ক্যান করা হয়। এ ধরনের স্ক্যানিং মেশিন বিশ্বের বড় বড় বিমানবন্দরে ব্যবহার করা হয়। এ মেশিন দিয়ে কোনো বিপজ্জনক বস্তু পেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment