রহমতের পরশ লাভের চেষ্টা কর

আল্লাহর অফুরান দয়া ও মেহেরবানি সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজিত মিসরের নীলনদের স্বচ্ছ সলিলের মতো। কিন্তু আমাদের মাথায় যখন ফেরাউনি মনোভাব ভর করে, যখন নফসে আম্মারার তাবেদার হয়ে যাই, স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেই, তখন রহমতের সেই ঝরনাধারা গাঢ় কালো রক্তে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কোরআন মজিদে সূরা আরাফের ১৩৩ নম্বর আয়াতের তাফসিরে মুফাসসিররা বলেন, আল্লাহ তায়ালা হজরত মুসা (আ.) কে যেসব অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন তার একটি ছিল, ফেরাউনের স্বজাতি কিবতিদের জন্য নীলনদের পানি রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। ফেরাউনের স্বগোত্রের নাম ছিল কিবতি। এরা ছিল মিনরের শাসকগোষ্ঠী। শাসিত শ্রেণি ছিল মুসা (আ.) এর স্বজাতি বনি ইসরাইল। তাদের আরেক নাম ছিল সিবতি।
নীলনদের পানি রক্তে পরিণত হওয়ায় কিবতিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এক কিবতি একদিন পরিচিত এক সিবতির কাছে এসে বলে, আমি তোমার পরিচিত বন্ধুজন। এসেছি কারণ তোমার বাসায় নীলনদের পানি আসে সুপেয়। সেই পানি আমার বাসায় যায় রক্তমাখা। মুসাই জাদু করে নীলনদের পানি আমাদের জন্য রক্তে পরিণত করেছে। আমাদের বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ, পিপাসায় প্রাণ যায় যায়। বাধ্য হয়ে তোমার কাছে এসেছি। চলো তোমার পাত্রটি নিয়ে পানি তুলে দাও, বুকফাটা তৃষ্ণায় একটু যেন স্বস্তি পাই।
কিবতির অনুরোধে সিবতি রাজি হয়। পানির সুরাহি নিয়ে নীলনদে যায়। পানির পাত্র থেকে অর্ধেকটা পান করে বাকি অর্ধেক কিবতিকে দেয়। কিন্তু আশ্চর্য, সেই পানি কিবতি মুখের কাছে নিতেই রক্তে পরিণত হয়ে যায়। একই পানি সিবতি পান করলে সুপেয়, কিবতি মুখে নিলে রক্তবর্ণ। কিবতি প্রচ- রেগে যায়। দাঁত কড়মড় করে বলে, মুসার কেমন জাদু! কিন্তু যে নিরুপায়। মেজাজ শীতল হলে সিবতিকে বলে, বন্ধু! তুমিই বল, এই গিঁট খুলবে কীভাবে?
আই বেরা’দর! ইন গিরাহ রা’ চা’রা চীস্ত
গোফত ইন রা’ উ খোরদ কূ মুত্তাকীস্ত
হে ভাই! এই গিঁটের জট খুলবে কীভাবে
বলল, এ পানি মুত্তাকিই শুধু পান করবে।
কিবতির প্রশ্নের উত্তরে সিবতি বলল, আল্লাহর নেয়ামত এই পানি মুত্তাকিরাই শুধু পান করতে পারবে। মুত্তাকি কারা? যারা ফেরাউনের পথ ছেড়ে, গর্ব অহংকার ক্ষমতার দম্ভ ছেড়ে দিয়ে মুসার পথ, আল্লাহর নবীদের দেখানো পথ অবলম্বন করে তারই মুত্তাকি, নেককার, পরহেজগার। কাজেই মুসার পথ ধর, মুসার স্বজাতির সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোল। আকাশের চাঁদের আলোতে নিজেকে মেলে ধর, রহমতের জ্যোৎস্নার বন্যায় তোমার জীবন তখন হেঁসে উঠবে। হকিকতের সূর্যের সঙ্গে সংঘাতের জেদ যতদিন পোষণ করবে, বল ততদিন কীভাবে তোমার অন্তরের নদীতে ঈমান ও সৌভাগ্যের প্রস্রবণ প্রবাহিত হবে?
তোমার মাথায় যে বড়ত্ব অহমিকার দেমাগ কাজ করছে তা তওবার পানি দিয়ে মাগফেরাতের বারিধারায় স্নাত কর। তুমি তো মিথ্যার জালে জড়িয়ে আছ, সত্যের উদ্ভাস কীভাবে তোমার অন্তরে আলো বিকিরণ করবে? নানা ফন্দিফিকির ছাড়, মুসার স্বভাব ধারণ কর, নচেত সত্যকে বোঝার শক্তি তোমার হবে না।
মওলানা রুমি মসনবির যারা সমালোচনা করে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তুমি তো মসনবির গল্প উপমার মধ্যে ঘুরপাক খাও, তার আসল হকিকত কীভাবে তোমার বুঝে আসবে। মসনবি সেই রূপসীর মতো যে সুন্দর সাজ পরে লোকসম্মুখে হাজির হয়েছে। সে তো পোশাকের আবরণে নিজেকে তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে। অতীতের জাতিগুলোর বর্ণনা দেখে কোরআন মজিদও ইতিহাস গ্রন্থ বলে ভ্রমের মধ্যে পতিত হয় বাহ্যদর্শীরা। এর কারণ, যতক্ষণ আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানির সংযোগ না ঘটে, কোনটা আসল, কোনটা নকল বোঝা সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে।
ওয়ার না’ পুশ্কো মুশক পীশে আখশামী
হারদো য়্যাকসা’ন আস্ত চোন নবূয়াদ শামী
বিষ্ঠা ও মিশক নিয়ে যাও নসিকান্দ্রিয়হীনের কাছে
গন্ধ শুঁকার শক্তি নাই তাই উভয়ই এক সমান হবে।
যার নাসিকান্দ্রিয় বিকল হয়েছে, বাসগন্ধ পায় না, তার নাকের সামনে বিষ্ঠা নেওয়া হোক বা মিশক আম্বর ধরা হোক, উভয়ের মধ্যে ফারাক করতে পারবে না। নবীজির মহান সত্তার স্বরূপ দর্শনের ব্যাপারটিও অনুরূপ। যার অন্তরে সত্যের প্রতি আকর্ষণ আছে, সে-ই শুধু তার চেহারার হকিকত বুঝতে পারে, তার আদর্শকে আলিঙ্গন করতে পারে; যাদের অন্তর কলুষিত, নেফাকে ভরা, কুফরির রোগে আক্রান্ত আবু জাহলের মতো দাম্ভিক, নবীজি আর নবীজির আদর্শের সৌন্দর্য দেখার শক্তি তাদের নেই।
গোফত ইয়াযদা’ন কে তোরা হুম ইয়ানযুরূন
নকশে হাম্মাম আন্দ হুম লা য়ুবসিরূন
আল্লাহ বলেন, তারা তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে
হাম্মামের নকশা তারা, দেখতে পায় না তাই তোমাকে।
কোরআন মজিদে সে কথাই বলা হয়েছে, ‘আপনি যদি তাদের সৎপথে আহ্বান করেন তারা শুনবে না এবং আপনি দেখবেন যে, তারা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে; অথচ তারা আপনাকে দেখতে পায় না।’ (সূরা আরাফ : ১৯৮)।
হাম্মাম, গণগোসলখানা। বাজারে রাস্তার ধারে গণগোসলখানার বাইরে দেওয়ালে ছবি আঁকা থাকত সাধারণ লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। অঙ্কিত বীরের ছবির গোটা গোটা চোখ দুটি যেন তাকিয়ে আছে দর্শনার্থীর দিকে। মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, যারা দুনিয়াপূজারি বাহ্যদর্শী তারা হাম্মামের ছবি দেখে বলবে, চোখ দুটি জীবন্ত তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এ চেতনায় কতক লোক মূর্তির সামনে শ্রদ্ধায় নত হয়, প্রণতি জানায়। প্রণামের জবাব দিতে ভাস্কর্য ঠোঁট বা মাথা নাড়ছে না দেখে বেজায় নাখোশ হয়। এরা বাহ্যদর্শী, বাইরের আকৃতি পর্যন্ত এদের চিন্তার গতি। তাই আকৃতিকে জীবন্ত ভেবে মাথা  ঠোকায়। আকৃতির ভেতরে যে প্রকৃতি তার রহস্য এদের জানা নেই।
বিশ^াসী বান্দাও সিজদায় লুটায় আল্লাহর সমীপে। আল্লাহও দুই ঠোঁট নেড়ে জবাব দেন না বান্দার ইবাদতের পরিপ্রেক্ষিতে। মওলানা বলেন, আল্লাহ ঠোঁট নেড়ে জবাব না দিলেও তোমার ভেতরটা ভরে দেন আত্মিক প্রেরণায়। সেই প্রেরণায় প্রাণিত হয়ে শত সিজদায় নত হয় তোমার চিন্তাবুদ্ধি ও অন্তর। তুমি যদি কোনো প্রাজ্ঞ লোকের সান্নিধ্যে যাও, বিনিময়ে তুমি কী পাবে? নিশ্চয়ই তার দোয়া বা আশীর্বাদ। তিনি তোমাকে সৎপথটিই বাতলে দেবেন। মহান ব্যক্তির আশীর্বাদ ও হেদায়েতে তোমার মনপ্রাণ প্রফুল্ল হবে। এগুলো নির্বস্তুক। সিজদার বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত প্রেরণায় তোমার অন্তরাত্মাও পুলকিত, বিকশিত হয়। জগতের হাজারো টানাপড়েনের মাঝে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অবিচল থাকার শক্তি পাও। আল্লাহ সম্মতি জানিয়ে তোমার দিকে মাথা ঝুঁকান না ঠিক; কিন্তু তিনি বিনিময়ে তোমাকে বানান সবার মাথার মুকুট।
ব্যাপারটা বোঝার জন্য লক্ষ্য কর, পাহাড়ে খনিতে অজস্র পাথরের মাঝে কিছু পাথরে রহমতের দৃষ্টি দেন। তাতে মামুলি পাথরকে অমূল্য রতেœ পান্না, চুন্নি, স্বর্ণ, রৌপ্যে পরিণত করেন। ঝিনুকের বুকে মুক্তার বিস্তার ঘটান তিনি। দেখ, মানুষ মাটির সৃষ্টি; অথচ সেই মানুষের অন্তরে খাস দৃষ্টি দিয়ে প্রতীভার স্ফুরণ ঘটান। তারপর আকাশের চাঁদের মতো তাকে জগতের শীর্ষে খ্যাতিমান করেন। অথচ দুনিয়াপূজারিরা শুধু বাহ্য আকৃতিই বোঝে। আকৃতির ভেতরে লুকায়িত প্রকৃতির সন্ধান তারা পায় না।
কিবতি বলল, হে ভাই সিবতি! আমি বুঝেছি, সত্যের পরিচয় পেয়েছি। আমি তোমার কাছে দোয়া চাই। আমার অন্তরটা কালো। তাই দোয়া করার মুখ আমার নেই। তোমার মতো লোক দোয়া করলে আমার দিলের তালা খুলে যাবে, সত্যকে গ্রহণ করার, শয়তানি চক্রের হাত থেকে চিন্তা ও মন মুক্ত হওয়ার পথ আমি খুঁজে পাব।
সিবতি তখন এক গ্লাস পানি দিল কিবতিকে নীল নদের। এই পানি আর রক্ত নয়, সুপেয় প্রাণবর্ধক। পান করে মনে হলো কিবতির জীবনের যত তৃষ্ণা মিটে গেছে। এ তো পানি নয়, ঈমানের শরবত, শরাবান তাহুরা। সিবতি সিজদায় লুটিয়ে কাতর কণ্ঠে কাঁদে কিবতির জন্য। প্রভু হে! তোমার কাছে দোয়া করার প্রেরণা তো প্রথমে তুমিই দাও। সেই দোয়া আবার তুমিই কবুল কর। কাজেই শুরু ও শেষে একমাত্র তুমিই। কিবতির ঈমানের জন্য প্রাণান্ত দোয়ায় সিবতি আত্মহারা। একবার সম্বিত ফিরে পায় আবার হারিয়ে যায় ধ্যানের তন্মতায়। এরই মধ্যে অন্তর দুমড়ে-মুচড়ে বাঁধভাঙা কান্নায় চিৎকার দেয় কিবতি, বন্ধু হে! আমার অন্তরে মুসার প্রতি ঈমানের স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমাকে মুসার কালেমা দাও। তুমি সিবতি নও, তুমি মানুষ নও, আমার জন্য বেহেশতের দূত। আমি গিয়েছিলাম নীলনদের পানিতে প্রাণ জুড়াতে। বেহেশতের আবেহায়াতের বান এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনন্ত সাগরে। আমি এখন এখানে অপরূপ মিষ্টান্ন খেয়ে মাতোয়ারা, আত্মহারা।
শরবতী খোরদম যে আল্লাহুশ তারা
তা’ বে মাহশর তিশনাগী না’য়দ মোরা
পান করেছি ‘আল্লাহ কিনে নিয়েছেন’ আবেহায়াত
কিয়ামত পর্যন্ত স্পর্শ করবে না আমায় তৃষ্ণার হাত।
হ্যাঁ, আমি সেই সাগরের সন্ধান পেয়েছি, যেখানের ব্যবসা-বাণিজ্য সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে। কোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মোমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, বিনিময়ে তাদের জন্য আছে জান্নাত …।’ (সূরা তওবা : ১১১)।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment