ভোটারে নয়, পুলিশেই আস্থা প্রার্থীদের!

ভোটারে নয়, পুলিশেই আস্থা প্রার্থীদের!

উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন প্রার্থী ভোটার নয়, পুলিশের ওপরই ভরসা করছেন। বিভিন্ন প্রার্থী ও আওয়ামী নেতার সঙ্গে কথা বলে এবং দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে। জানা গেছে, নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থীও জয় পেতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ামক মনে করছেন। বিভিন্ন প্রার্থীর এ ধরনের বিস্তর অভিযোগও জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। তবে ইসি এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে। অভিযোগের মুখে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবুও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্ভরতা পুলিশেই।

গতকাল রবিবার ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘কিছু পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে দুটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বদলির প্রস্তাব কমিশন অনুমোদন দিয়েছে, তা হলো মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও গাইবান্ধার ফুলছড়ি। এ ছাড়া দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, বগুড়ার শিবগঞ্জ, নওগাঁর মান্দা এবং বান্দরবানের আলীকদম থানার ওসিকে আগামীকালের (আজ) নির্বাচনী কর্মকাণ্ড

থেকে অব্যাহতি দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা কিছু অভিযোগ পেয়ে তা তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছি যার পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা আমাদের নিতে হয়েছে।’

কক্সবাজারের চকরিয়ায় নৌকার প্রার্থী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীকে জেতাতে আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভোট কারচুপির ছক এঁকেছেন বলে অভিযোগ করেছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা যাই ভোটারের কাছে, তারা যায় (নৌকার প্রার্থী) পুলিশ প্রশাসনের কাছে।’ পাল্টাপাল্টি এমন অভিযোগ রয়েছে অনেক উপজেলায়ই। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিএনপি না আসায় ভোটারদের কেন্দ্রে আসার আগ্রহ এমনিতেই কম। আবার তাদের ভোটকেন্দ্রে আনতে প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছেন না প্রার্থীরাও।

চকরিয়ায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, ‘নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী ও স্থানীয় পুলিশের অন্তত ৫০ জনকে মোটা অঙ্কের টাকায় ম্যানেজ করা হয়েছে। তাদের নিয়ে গোপন বৈঠক করা হয়েছে উপজেলা পরিষদের কাছে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতার বাসায়। এসব বিষয় সবকিছু দেখভাল করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম; সঙ্গে রয়েছেন পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরীসহ দলীয় সিনিয়র নেতারা।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলার ৯৯টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৫০টি কেন্দ্র বাছাই করে কীভাবে ভোট কারচুপি করা যায় সেজন্য নৌকার প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে দাগি ও সন্ত্রাসী শ্রেণির লোকদের ঠিক করা হয়েছে কেন্দ্রভিত্তিক। মোটা অঙ্কের টাকায় ম্যানেজ হওয়া এসব কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার, পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় ভোটের আগের রাতে তারা এসব কেন্দ্র দখলে নিয়ে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সভর্তি করবে।’

তবে এ অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের মতো আমিও চাই একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠান হোক এখানে। আর যেসব প্রার্থী আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তার কোনো সত্যতা নেই।’

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় নৌকার প্রার্থী মুহম্মদ মুনজিল আলী সরকারের অভিযোগ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী সাহাদারা মান্নান স্থানীয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করে এ নির্বাচনে তার কর্মীদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘এমপি মান্নানের ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে নেতাকর্মীদের নৌকা মার্কার বিপক্ষে কাজ করতে বাধ্য করছেন সাহাদারা মান্নান। কেউ মানতে না চাইলে তাকে প্রশাসনিক হয়রানি ও দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিচ্ছেন তিনি।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নৌকার প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থী উভয়েই আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় এ সুযোগটি গ্রহণ করছে স্থানীয় প্রশাসন। এক্ষেত্রে যে অঞ্চলে যার শক্তিমত্তা বেশি তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তারা। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না থাকায় প্রশাসনের সহায়তার অভিযোগটিও তেমন আমলে নেওয়া হচ্ছে না। কারণ যেই জিতুক তিনি তো আওয়ামী লীগেরইÑ এমন একটি ধারণা কাজ করছে।

জানতে চাইলে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রথম কথা হলো ভোটারদের মধ্যে ভোট না দেওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়েছে। ভোটাররা মনে করে প্রার্থী তো নিজেরা নিজেরাই, তাই ভোটকেন্দ্রে না গেলেও জিতবে তো তারাই (আওয়ামী লীগ প্রার্থী)। দেশের একটি বড় অংশের মানুষের ভেতরে ভোট দেওয়ার ‘প্র্যাকটিস’ তৈরি হয়নি উল্লেখ করে তৃণমূলের এ নেতা বলেন, ‘প্রার্থীরাও এখন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। প্রার্থীরা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রতি ঝুঁকে গেছেন, তাদের ম্যানেজ করতে পারলে বিজয় নিশ্চিত মনে করে।’

উপজেলা নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের অনুপস্থিতিতে অস্বস্তিতে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ছাড় দিয়েও সুফল পাচ্ছে না দলটি। দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলছেন, বিষয়টি আমাদের কাছে উদ্বেগ ও অস্বস্তির। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মূলত বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাতেও ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তারা আরও বলছেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের অসহযোগিতার ফলে নির্বাচন জমানোর ক্ষেত্রে নেওয়া উদ্যোগগুলোর সুফল আসছে না। স্থানীয় নেতারা বিজয় নিশ্চিত করতে ছাড় দিতে চাচ্ছেন না কিছুতেই। আবার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তও মানছেন না। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কেন্দ্রের নির্দেশ থাকলেও অনেক উপজেলায় স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে জয়ের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পেতে চাইছেন প্রার্থীরা। সেজন্য ভোটারদের দরজায় না গিয়ে ভোট সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিতদের সহযোগিতাই বেশি আশা করছেন তারা।

এ সম্পর্কে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসতে চায় না। বিএনপি ভোটে না থাকায় তাদের সমর্থকরাও কেন্দ্রে আসে না। স্বাভাবিকভাবেই ভোটার উপস্থিতি কম থাকে। এ ছাড়াও অন্য অনেক হিসাবও আছে।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment