ধর্ষণে বাড়ছে ভয়াবহতা

সবার আদরের মেয়েটিকে কেউ ডাকেন সাগরিকা, কেউ তৃপ্তি, কেউবা তিলুনি। পড়ে রাজধানীর বিজি প্রেস উচ্চ বিদ্যালয়ে, পঞ্চম শ্রেণিতে। সংসারের অভাব তাড়াতে ওর মা-বাবা দুজনেরই যুদ্ধ চলে সারাদিন। এমনই একদিন ভোরে, কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান তৃপ্তির মা-বাবা। কিন্তু বের হওয়ার সময় তারা ঘরের দরজা মনের ভুলে বন্ধ করে যাননি। আর এ ভুলের জন্য যে এত বড় মাসুল দিতে হবে, তা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি তৃপ্তির মা-বাবা।

পাশের এক ভাড়াটিয়া যুবক, নাম আলম বিশ্বাস। এই পাষ- ঘরে প্রবেশ করে তৃপ্তিকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তৃপ্তি এতে বাধা দেয়। শেষ পর্যন্ত ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে সে তৃপ্তির মুখে বালিশচাপা দিয়ে এবং গলা টিপে হত্যা করে। সেই সঙ্গে হত্যা করে একটি পরিবারের তাবৎ সুখ, স্বপ্ন। ২০১৮ সালের ৪ আগস্টের ঘটনা এটি।

এর পর পেরিয়ে গেছে সাড়ে নয় মাস। মর্মান্তিক এ ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে ঢের। সে সময় সিসি ক্যামেরায়ও ধরা পড়েছিল খুনির পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কিন্তু এ পর্যন্ত তৃপ্তির ঘাতককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। সম্প্রতি তেজগাঁও বেগুনবাড়ীর সিদ্দিক মাস্টার ঢালে তৃপ্তিদের বাসায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন তৃপ্তির মা রওশন আরা।

বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে মেয়ের জন্য আহাজারি শুরু করেন তিনি। অনেক কথার পর অশ্রুসজল এই নারীর শেষ কথা ছিলÑ তৃপ্তির খুনির বিচার হবে তো? এমন হৃদয়চেরা কষ্ট, সন্তান হারানো আহাজারি, এমন প্রশ্ন শুধু তৃপ্তির মায়েরই নয়। দেশে প্রতিদিনই নরপশুদের লালসার শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারাচ্ছে অনেক তৃপ্তি, ঝরে যাচ্ছে প্রাণ। প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে নিগ্রহ-নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা এমনকি স্বার্থের বলি হতে হচ্ছে শিশুদেরও। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নিপীড়ন-নির্যাতনে যোগ হচ্ছে বর্বরতা, নৃশংসতার নতুন নতুন ধরন। পরিবারের সদস্য, শ্বশুরবাড়ির লোকজন, সহকর্মী, যানবাহনের চালক-সহকারী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও শিক্ষাগুরুর নামও উঠে আসছে অসভ্য নির্যাতনকারীর তালিকায়।

ঘরে-বাইরে সর্বত্র নিগৃহীত হয়ে, সম্ভ্রম হারিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে অনেকেই। ক্রমেই বাড়ছে এসব ঘটনার সংখ্যা। গত ৬ মে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে স্বর্ণলতা পরিবহনের চলন্ত বাসে ইবনে সিনা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়াকে ধর্ষণের পর তা ধামাচাপা দিতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর এ হত্যাকে সাজানো হয় দুর্ঘটনা হিসেবে।

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের রাতে ভিন্নমতাবলম্বীকে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে নোয়াখালীর সুর্বণচরে ৪ সন্তানের জননীকে পরিবারের সামনে ধর্ষণ করে নরপিশাচের দল। আর ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা তো এখন দেশজুড়েই আলোচিত। সাভারে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এসে গত সোমবার ধর্ষিত হয় ঝিনাইদহের মহেশপুরের এক স্কুলছাত্রী।

৬ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের হাছান মিয়া নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির লালসার শিকার হয় ৮ বছরের এক শিশু। ৫ মে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কুপতলা ইউনিয়নে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী এক এতিম শিশুকে ধর্ষণ করে বখাটে এক যুবক। ৮ মে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রানীপুকুরে নির্জন ভুট্টাক্ষেতে নিয়ে প্রথম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ করে এক পাষ-।

বরিশালের গৌরনদীতে দশম শ্রেণির ছাত্রীকে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে দুই বখাটেকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসের হিসাবেই দেখা গেছে, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ ও খুন বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসেই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬২৪ নারী ও শিশু।

এদের মধ্যে ৩৫৪ জনই ধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৮ জনকে। ৬ ভুক্তভোগী ধর্ষণের পর লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করে। ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয় একজনকে। এ চার মাসে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে ১৪৪ শিশু। আর চলতি মে মাসের প্রথম ১০ দিনে ৪৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে নিজেরই পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১২৮ নারী।

এদের মধ্যে খুন হন ৯১ জন। আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ১৮ নারী। গত ১২০ দিনে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১১ গৃহকর্মী। এদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৬ জন। একই সময়কালে অ্যাসিডসন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৯ তরুণী। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে সংস্থাটি এ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। অপরাধ বিশ্লেষকদের অভিমত, নারী-শিশু নির্যাতনে এখন নৃশংসতার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।

সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে পরিবারেও সহিংস ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যা, অবাধ পর্নোগ্রাফি ও ফেসবুক ব্যবহার, মানসিক বিপর্যয়, স্বামী বা স্ত্রীর পরকীয়া, নিরাপত্তাহীনতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মাদকাসক্তির কারণেও এসব কা- বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা, দুর্বল তদন্ত ও আইনের ফাঁক গলে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়াÑ ইত্যাদি কারণে এই ‘সামাজিক ব্যাধি’ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে বিচারপ্রার্থীরা আইনের আশ্রয় নেওয়ার শুরু থেকেই মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন; দীর্ঘ সময় ধরে চলে বিচারকাজ। ফলে আদালতে মামলা স্তূপীকৃত হচ্ছে। স্বল্প সময়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সমতাভিত্তিক আইননীতি বাস্তবায়িত হলে এবং অপসংস্কৃতির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারলে ধর্ষণ, নারী-শিশু নির্যাতন কমে আসবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে সারাদেশে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার ৩ হাজার ৯১৮ শিশু-নারী। এদের মধ্যে ধর্ষিত ৬৯৭ জন; গণধর্ষণের শিকার ১৮২ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৬৩ জনকে। শ্লীলতাহানি ও যৌন নিপীড়িত হয়েছেন ২১৭ জন; হত্যা করা হয়েছে ৪৮৮ শিশু-নারীকে। খুনের হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন ৩৯ জন। এমনকি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯ জন।

২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৩ হাজার ৫৩২ শিশু-নারী। তাদের মধ্যে ধর্ষিত ৫ হাজার ১৮৪ জন; গণধর্ষণের শিকার ১ হাজার ২৮৭ জন; ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৪৯ জনকে। শ্লীলতাহানি ও যৌন নির্যাতিত ১ হাজার ৪৪৫ জন; হত্যা করা হয়েছে ৫ হাজার ৩০৪ শিশু-নারীকে। খুনের হাত থেকে বেঁচে গেছেন ৪০০ জন। এ সময়কালে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৪৯ শিশু-নারী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সংস্থাটি।

আপনি আরও পড়তে পারেন