রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই এমপি লিটনকে হত্যা

জোটমিত্র জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি কাদের খানের হাতে খুন হন আওয়ামী লীগের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন। কিন্তু কাদের খান গ্রেফতার হওয়ার আগে ঘুর্ণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেনি গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জের মানুষ। স্বাধীনতা বিরোধী জঙ্গি-জামায়াতের বিরুদ্ধে লিটনের লড়াকু পরিচিতির আড়ালে খুন করে নিজের রাজনৈতিক পথ খুলতে চেয়েছিলেন কাদের। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পৌনে দু’মাস পর একটি ছিনতাই মামলার তিন আসামির কাছ থেকে বেরিয়ে আসে রাজনৈতিক এ হত্যাকাণ্ডের আসল কুশিলবের নাম। 

২০০০ সালে ঘোষণা দিয়ে সুন্দরগঞ্জের মাটিতে জামায়াতের আমির গোলাম আজমের আগমন প্রতিরোধের মাধ্যমে রাজনীতিতে আবির্ভূত মনজুরুল ইসলাম লিটন মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। জঙ্গি-জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়াকু অবস্থানই তাকে জনপ্রিয় আর স্বাধীনতা সপক্ষশক্তির মূল কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে বামনডাঙ্গায় চার পুলিশ হত্যা, পরের বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার মূল টার্গেট ছিলেন লিটন। তাই ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে আততায়ীর গুলিতে খুন হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে সবার সন্দেহের তীর ছিল জামায়াত-শিবিরের দিকেই। কিন্ত ঘটনার পৌনে দু’মাস পর যে সত্য প্রকাশ হয়, তা সবাইকে বিষ্মিত করে।

Epsoon Android tv

এমপি লিটন হত্যার ঘটনায় একটি মামলা হলেও তাতে আসামির নাম ছিল না। আততায়ী হিসেবে এক সময় তার স্ত্রী স্মৃতিকেও সন্দেহে আনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু লিটন হত্যার এক মাস আগের এক ছিনতাই মামলার ঘটনাস্থলে পাওয়া পিস্তলের ম্যাগজিন ও লিটন হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলের গুলি মিলে যায়। ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া মোবাইলের সূত্র ধরে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয় শাহীন, রানা ও মেহেদী। তারাই সব রহস্যের জট খুলে দেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় কাদের খান ও অন্য আসামিদের।

গাইবান্ধা জজকোর্টর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট শহীদুল হক খোকন বলেন, ‘আমাদের এ জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করে আামদের ওপর চাপ দিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চেয়েছিলেন কাদের খান।’

লিটনের এ হত্যাকাণ্ডকে রাজনীতির বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ হিসেবে দেখছেন তার সহকর্মীরা।

গাইবান্ধা  জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ফরহাদ আব্দুল্লাহ হারুন বাবলু, ‘আমাদের মিত্র যাদের ভাবি তাদেরই একজন কর্নেল কাদের। তিনি এমন এক জঘন্য অপরাধ করেছেন তা ভাবা যায় না।’

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে দুটি আসনে পরাজিত হয়েছিল তার একটি ছিল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসন। ১৯৭৩ সালে একবারই জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের নির্বাচনেও এখান থেকে জয়ী হয় যুদ্ধাপরাধের মামলায় দণ্ডিত পলাতক ফাঁসির আসামি রাজাকার আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ। ২০১৪ সালে মনজুরুল ইসলাম লিটনের মাধ্যমে আসনটি ফিরে পায় আওয়ামী লীগ।

২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের শাহবাজ গ্রামের মাস্টারপাড়ার বাড়িতে লিটনকে গুলি করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। সেখানেই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মারা যান তিনি।

এ ঘটনায় অজ্ঞাত পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন লিটনের বড় বোন ফাহমিদা কাকলী। তদন্ত শেষে কাদের খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

সেখানে বলা হয়, ২০১৫ সালের শেষ দিকে এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আব্দুল কাদের খান। লিটনকে সরিয়ে ভোটের রাজনীতির পথ সুগম করতেই এমন চক্রান্ত করেন সাবেক এমপি কাদের খান।

মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনমঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ডের এক মাস ২১ দিন পর বগুড়া শহরের কাদের খানের স্ত্রীর মালিকানাধীন গরিব শাহ ক্লিনিক থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

এরপর কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। প্রথম রিমান্ডে থাকা অবস্থার চতুর্থ দিনের মাথায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে লিটন হত্যার দায় স্বীকার করেন আব্দুল কাদের খান।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয়। মামলার বাদী, নিহতের স্ত্রী ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ৫৯ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।

সাক্ষ্য-প্রমাণের পর বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে প্রধান আসামি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. আবদুল কাদের খানসহ ৭ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ দিলীপ কুমার ভৌমিক।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন-  কাদের খানের একান্ত সহকারী মো. শামছুজ্জোহা, গাড়িচালক আবদুল হান্নান, গৃহকর্মী মেহেদি হাসান, দূর সম্পর্কের ভাগ্নে ও বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শাহীন মিয়া, সাবেক পোশাকশ্রমিক আনোয়ারুল ইসলাম রানা ও পলাতক চন্দন কুমার রায়।

একই ঘটনায় অস্ত্র মামলার রায়ে গত ১১ জুন আব্দুল কাদের খানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া অস্ত্র মামলায় পৃথক এক ধারায় তাকে ১৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন