দখল-দূষণে মরছে নবাবগঞ্জ ও দোহারের কালের সাক্ষী ইছামতী নদী।

ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহারের কালের সাক্ষী ইছামতী নদী। একসময় নদীটি দিয়ে চলাচল করত বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ। এ অঞ্চলের মানুষের চলাচলের প্রধান ছিল নদীপথ। নদীতেও ছিল প্রবল স্রোত এবং নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ। তখন নদীর সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের ছিল গভীর প্রেম। দিন-রাত শোনা যেত নদীর কলকল শব্দ। সেই ঐতিহ্যবাহী ইছামতী নদী আজ নাব্য সংকটে মরতে বসেছে।

প্রকৃতির টানে যেখানে নদীটিকে বাঁচাতে মানুষ কাজ করার কথা, সেখানে উল্টো অবৈধ দখল ও দূষণ করে মারছে নদীটিকে। বর্তমানে ইছামতী মৃতপ্রায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, নদীভাঙন ও বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে ইছামতী নদীতে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দোহারের অরঙ্গাবাদ থেকে মানিকগঞ্জের হাটিপাড়া বংখুরী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। বেড়িবাঁধের কারণে সে যাত্রায় নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পেলেও সেই বেড়িবাঁধই এখন ইছামতীর মরার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অদক্ষতা ও অপরিকল্পতায় বাঁধের ইছামতী-পদ্মা নদীর সংযোগ স্থলে সøুইস গেট (জলকপাট) স্থাপন না করা এবং বহু বছরেও নদীটি খনন না করায় ইছামতী এখন বিলুপ্তির পথে।

স্থানীয়রা জানায়, নদীতে লঞ্চ চলত, শুশুক দেখা যেত, পাওয়া যেত বড় বড় মাছ এসব ঘটনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে কল্পকাহিনী। আশির দশকেও রাজধানীতে যাতায়াতে ইছামতী নদী ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আর ব্যবসায়ীদের যাবতীয় মালামাল আনা নেওয়ার সহজ ব্যবস্থাই ছিল এ নৌপথ। ইছামতী নদী দিয়ে ঢাকার সদরঘাট থেকে বড়-বড় লঞ্চ চলাচল করত, এখন সেই নদী দিয়ে নৌকাও ঠিকমতো চলতে পারছে না। ইছামতী নদীর কিছু কিছু এলাকায় একদম পানি নেই, আবার কিছু কিছু এলাকায় হাঁটুপানি থাকলেও কচুরিপানায় ঢেকে আছে। কচুরিপানার পচনে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্গন্ধ। ইছামতী নদীর ওপর কার্তিকপুর এলাকায় রাস্তা নির্মাণ করায় এখন নৌকা চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া কাশিয়াখালী এলাকায় বেড়িবাঁধ দেওয়ায় ওই পথেও ইছামতী নদীতে পানি আসা বন্ধ। ঢাকা জেলার অন্যতম বৃহত্তম কোঠাবাড়ীর বিলসহ প্রায় শতাধিক বিলে আজ পানির অভাবে ধানচাষ করতে পারছেন না কৃষক। একসময় এসব বিলেই চাষ হতো লাখ লাখ হেক্টর ইরি-বোরো।

সম্প্রতি ইছামতী নদীর তীর ঘুরে দেখা যায়, সুইস গেট আর দীর্ঘদিন খননের অভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে ইছামতী নদী। নদী শুকিয়ে শুষ্ক। নদীর মাঝখানে রোপণ করা হয়েছে ইরি ধান। আবার কোথাও নদীর মাঝখানে শুকনো জায়গায় আড়া বেঁধে রোদে শুকানো হচ্ছে কাপড়। কোনো কোনো স্থানে প্রভাবশালীরা নদী দখল করে অবৈধভাবে গড়ে তুলেছে বহুতল ভবন। এতে করে হারিয়ে যেতে বসেছে ইছামতীর আপন চেহারা। সমস্যায় পড়েছে স্থানীয় প্রায় পাঁচ হাজার জেলে পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার সদস্য। সেই সঙ্গে বেকার হয়ে পড়েছে নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজারও পেশার মানুষ। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে ঢাকা জেলার দোহার-নবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান ও মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ওপর।

স্বেচ্ছাসেবী কয়েকটি সংগঠন মূল নদীতে জলকপাট নির্মাণ ও খননের দাবি জানালেও কর্র্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সবসময়ই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। এছাড়াও নবাবগঞ্জের বান্দুরা থেকে কাশিয়াখালী এবং হাসনাবাদ থেকে কার্তিকপুর পর্যন্ত যে যেভাবে পারছে দখল করছে নদীর পাড়। কেউ নির্মাণ করছে বসতবাড়ি, কেউ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আবার কেউবা কৌশলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বানিয়ে নদী দখল করে নিচ্ছে। বিভিন্ন বাজারের মাংস বিক্রেতারা গরু ও মুরগির বর্জ্য এবং খাবার হোটেলের মালিকরা পচাবাসি খাবারগুলো নদীতে ফেলে। এছাড়া ইছামতী নদীর কোল ঘেঁষে যত্রতত্র গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত ক্লিনিকের বর্জ্য প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে নদীতে। একসময়ের তীব্র যৌবনা উত্তাল ইছামতী এখন নিস্তব্ধ হয়ে থুবড়ে গেছে অসুস্থ বৃদ্ধের মতো। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মইনউদ্দিন বলেন, কয়েকটি প্রকল্প ওপর মহলে জমা দেওয়া আছে। পাস হয়ে এলেই কাজ শুরু হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচএম সালাউদ্দিন মনজু বলেন, নদী দখলকারী যে-ই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইছামতী নদীকে রক্ষায় প্রশাসন অচিরেই অভিযানে নামবে।

News Source : দেশ রূপান্তর

 

আপনি আরও পড়তে পারেন