ঘাটাইলে দিলীপ মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হলেও জীবন যুদ্ধে পরাজিত

ঘাটাইলে দিলীপ মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হলেও জীবন যুদ্ধে পরাজিত

সৈয়দ মিঠুন, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি:


হাট-বাজার, চায়ের দোকান, ফিলিং স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড যেখানে মানুষের জমায়েত সেখানে দিলীপ মানুষকে গান শুনিয়ে আনন্দ দেন। গান শুনে খুশি হয়ে কেউ পাঁচ টাকা, দশ টাকা আবার কেউ পঞ্চাশ ১শ’ টাকাও দেন।

সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে সারাদিন যা পান, তা দিয়ে সন্ধ্যায় নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর দেখা মিলে ঘাটাইল কলেজ মোড় বংশাই গেস্ট হাউজের সামনে। গান শুনানোর ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

পুরো নাম দিলীপ কুমার দে (৮০)। বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বাগুটিয়া উত্তরপাড়া গ্রামে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ভিক্ষা করতে তার সম্মানে লাগে। তাই কণ্ঠ বিক্রি করেন দিলীপ। অসাধারণ তাঁর গানের গলা। ইদানিং নাকি শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। সব সময় জ্বর থাকে। হাঁটেন লাঠি ভর করে। পেটের দায়ে তবু বের হন প্রতিদিন।


দিলীপ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছি। কর্ণেল তাহেরের অধীনে। যখন খারাপ লাগতো, তখন গান ধরতাম। ওই সময় অনেক সহযোদ্ধাদের হারিয়েছি। হানাদারদের ছোঁড়া গুলি বুকে লেগে যখন পাশে থাকা বন্ধুরা কেঁপে কেঁপে মারা যেত, তখন খুব কষ্ট লাগতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন সড়কে গাড়ি চলাচল শুরু হয়, তখন বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি এসে ঘরের কোনো চিহৃ পাইনি।

আসবাবপত্রসহ ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল হানাদার বাহিনীরা। তিনি বলেন, এখন আবার যুদ্ধে নেমেছি, জীবন-জীবীকার যুদ্ধে। সময়ে সময়ে মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা, চড়া সুদে টাকা এনে চার বোন এবং দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। কোনো উপায়ন্তুর না দেখে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে টাকা ভাতা পাই, তার উপর লোন করি।

যা এখনো শোধ হয়নি। বছর খানিক আগে স্ত্রী মালতি দে মারা গেছেন। এখন বড় একা লাগে তাঁর! দু’জন ছেলেও আছে তাঁর। বিয়েও দিয়েছেন ছেলেদের। বড় ছেলে সিএনজি ভাড়ায় চালায়, আর ছোট ছেলে নরসুন্দর।

ছেলেরা যা আয় করে তা দিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে তাদেরই চলেনা। তিনি বলেন, জীবনের তাগিদে গান গাই, পুরনো দিনের গান। ক্ষণিক সময়ের জন্য মানুষকে আনন্দ দেই। খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই দু’হাত পেতে নেই। করোনার এই মহামারীর সময়ে চলা খুবই কষ্ট হয়ে পড়েছে। ভয়ে মানুষ কাছে আসতে চায়না। তাই আগের মতো আর পয়সা পাইনা।

মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে নয়, জীবনের শেষ বয়সে এসেও কিছু একটা করে খেতে চান দিলীপ। ছোট-খাটো একটা মুদি দোকান হলেই নাকি চলবে। এ কাজে কেউ সাহায্য করলে গ্রহণ করবেন বলে দিলীপ জানান।
’তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয় দুখের দহনে করুন রোধনে তিলে তিলে তার ক্ষয়….’ গানটি গাওয়া শেষ করে বিদায় নিলেন মুক্তিযুদ্ধে জয়ী, জীবন যুদ্ধে পরাজিত দিলীপ কুমার দে। চলে গেলেন, ফেলে গেলেন এক দীর্ঘশ্বাস।

আপনি আরও পড়তে পারেন