নামিদামি ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রেমের ফাঁদ, অতঃপর…

নামিদামি ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রেমের ফাঁদ, অতঃপর...

পারভীন আক্তার নূপুর। গ্রামীণফোনের গ্রাহকদের তথ্য চুরি করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ফেলতো প্রেমের ফাঁদে। কখনো সাংবাদিক, কখনো-বা সমাজকর্মী হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন তিনি। পরিচয়পর্ব শেষে সখ্যতা গড়ে তুলতেন, নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতেন। এভাবে দেখা-সাক্ষাৎ, পরে আরও অন্তরিকতা। একপর্যায়ে নূপুর তাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের সঙ্গে হওয়া আন্তরিক কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সংগ্রহে রাখতেন তিনি। এছাড়া ঘনিষ্ঠ ছবিও কাছে রাখতেন এই নূপুর।

এরপর নানা অন্তরঙ্গ কথাবার্তা রেকর্ড করে তা প্রকাশের হুমকি দিয়ে দাবি করতো মোটা অংকের টাকা। এভাবে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্যবসায়ী বিশিষ্টজনদের সাথে প্রতারণা করে আসছিলেন প্রতারক চক্রের মূলহোতা পারভীন আক্তার নুপুর।

হেনস্তা করার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ রাখার পর উল্টো মনোভাব দেখানো শুরু করতেন প্রতারক নূপুর। শুরু হতো হুমকি-ধমকি দেওয়া। হুমকি দিয়ে বলা হতো, আমার কাছে থাকা সব রেকর্ড ও ছবি আপনার পরিবার বা স্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, সেই কথাও জানিয়ে দেব। আর তা না হলে আমাকে টাকা দিতে হবে।

নূপুর যাদের এই হুমকি দিতেন, তাদের বেশির ভাগই সমাজে প্রভাবশালী এবং সম্মানিত ব্যক্তি। সেজন্য, মান-সম্মানের ভয়ে তারা মুখ খুলতে পারতেন না। ফলে নূপুরের চাহিদামতো টাকা দিতে বাধ্য হতেন তারা। এই প্রক্রিয়ায় নূপুর ২০ থেকে ২৫ জন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ভুয়া আইনজীবীর মাধ্যমে ফোন করে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ মামলার হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো হয়। এই চক্রকে টার্গেট করা ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করে গ্রামীণফোনের সার্ভিস সেন্টারের কর্মী রুবেল মাহমুদ অনিক। চক্রের প্রধান পারভীন আক্তার নূপুর (২৮), তার বোন শেফালি বেগম (৪০), গ্রামীণফোনের কর্মী রুবেল মাহমুদ অনিক (২৭) এবং নূপুরের সহযোগী শামসুদ্দোহা খান বাবু (৪০) নামে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরপরই বেরিয়ে এসেছে এ ধরনের ভয়ঙ্কর প্রতারণার নানা তথ্য।

গত বৃহস্পতিবার থেকে রবিবারের মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, হাতিরঝিল ও বাড্ডা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা প্রতারণা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আইনজীবী পরিচয়দানকারী ইসা নামে চক্রের এক সদস্য এখনও পলাতক।

বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সকালে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ-হারুন-অর-রশীদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিতে যদি কোনো ঝামেলা হতো তাহলে ব্যবহার করা হতো ভুয়া আইনজীবী। আইনজীবী ইসা তাদের কল করে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলা দায়েরের কথা বলে হুমকি দিতেন। তিনি এখনো পলাতক আছেন। ইসা বিভিন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট বিল ভাউচার তৈরি করার কথাও জানাতেন প্রতারিতদের। এছাড়া এসব ব্যক্তির কাছে দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে পারভীনের বড় বোন শেফালী ওইসব ব্যক্তিকে কল করে মামলার হুমকি দিতেন। এদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় প্রতারণা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা করা হয়েছে।’

ডিসি হারুন বলেন, ‘এই চক্রের সঙ্গে যারা যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এমন হলে আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যের নিরাপত্তা কোথায়? মোবাইল অপারেটরের কোনো গাফিলতি থাকলে বা এই তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পারভীন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। মূলত তার কোনো পেশা নেই। পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে গুলশানের নিকেতনের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করেন তিনি। তার বড় বোন শেফালী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তিনি চাঁদনী চক মার্কেটে স্কার্ফ, হিজাব ও বোরকা বিক্রি করেন। আর অবিবাহিত শামসুদ্দোহা মোহাম্মদপুরে শেফালীর ফ্ল্যাটেই থাকেন। রুবেল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন নাবিস্কো মোড়ে অবস্থিত গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে কাজ করেন। ইসা আইনজীবী ও একটি ল ফার্মে কাজ করেন বলে প্রতারিত ব্যক্তিদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, পারভীনের দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই। অথচ তিনি প্রায় এক লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে গুলশানের নিকেতনের একটি বাসায় থাকেন। তার মেয়ের স্কুলের বেতন প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা। তিনি বনানীর ১১ নম্বর রোডের ই-ব্লকের গ্রিন ডিলাক্স হাউজ নামের একটি জিমে নিয়মিত যান। সেখানে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা বিল দেন। গুলশান থানায় তিনি একবার অভিযোগ করেছিলেন যে, তার ছয়টি লিপস্টিক চুরি হয়েছে, যার দাম ৯০ হাজার টাকা।

আপনি আরও পড়তে পারেন